অবশেষে অবসর

কি ভাবছ মিন্টু?
অতীত।
হঠাৎ অতীত। অতীত কেন?
ভবিষ্যৎ তো দেখা যায় না।
আর বর্তমান তো সব সময় অতীতের মাঝে ডুবে যাচ্ছে, তাই নয় কি?
বুঝলাম না।
এই যে তুমি জিজ্ঞাসা করলে “ বুঝলাম না”, এই প্রশ্ন টা আর বর্তমানে নেই, পিছনে চলে গেছে, ওটা অতীত।
ওই সব তাল বাহানা ছাড়ো। বলও কি ভাবছিলে।
সব কিছু ছেড়ে দিয়ে চলে এলাম আজ। পিছনে ফেলে এলাম আমার চুয়াল্লিশ বছরের কর্ম জীবন। সেই অতীতের দিনগুলো বার বার মনে করার চেস্টা করছিলাম।
একটু সহজ করে বলও।

আজ কর্ম জীবন থেকে ইস্থাফা দিলাম।
মানে?
মানে রিটায়ার করলাম।
আর আমাকে ভোর ছয়টায় উঠতে হবে না। ঘড়িতে অ্যালার্ম দিতে হবে না। বাহিরে অঝোর ঝরে বৃষ্টি আমাকে বাতীব্যস্ত করবে না। আমি পাশের বালিশটাকে বুকে চেপে ধরে আবারও ঘুমের মাঝে ঢলে পরবো।
হাসালে তুমি।
কেনও?
কারন আমি তোমাকে চিনি বলে। তোমাকে আমি দেখেছি তিলেতিলে বড় হয়ে উঠতে। তোমার মাঝে আছে অস্থিরতা। তুমি দুদণ্ড এক জাগায় বসতে পারনা। মনে পরে সে কি বলেছিল তোমাকে। বলেছিল, “ আচ্ছা, তোমাকে কি সব সময় বল্লায় কামড়ায়”।
তুমি যাও এখান থেকে। আমার আনন্দ টাকে মাটি করোনা। অফুরন্ত সময় আজ থেকে আমার হাতে।
কি করবে? এই অফুরন্ত সময় কি ভাবে কাটাবে ভেবেছ কি?
বেড়িয়ে পড়বো বিভিন্ন দেশ দেখতে। জড়িয়ে পড়বো বিভিন্ন সংগঠনের সাথে। সময় পাড় হয়ে যাবে।
তাই যেন হয়। তবে বলি কি, যাওয়ার আগে একটা কথা মনে রেখো।
কি?
ঐ যে ছোট বেলায় শুনেছ, Old is Gold, বড় বাজে কথা।
কেনও?
হার্ট বীট টা কত বার উঠা নামা করছে সেটা তো প্রতি রাতেই একবার দেখে নেও। তাই না? বিছানা থেকে উঠতে গেলে সাবধানে উঠতে হয়, কারন তা না হলে মাজার ব্যাথা টা চাড়া দিয়ে ওঠে। তাই নয় কি? আর কন্সটীপেসানের কথা নাই বা বললাম। এই যদি গোল্ড হয় তবে আমি তোমার সাথে একমত নই।
এই যে বলছিলে বেড়িয়ে পড়বে? এতসব প্রবলেম নিয়ে কোথায় বেড়িয়ে পড়বে বলও? বেড়িয়ে পড়তে গেলে সঙ্গে কাউকে তো নিতে হবে। একটা কথা বলার লোক। কোথায় পাবে? চারিদিকে তাকিয়ে একবার দেখো? আছে কি? তোমার পরিস্থিতি ভিন্ন। তোমার কথা বলার লোকের অভাব। কার সময় আছে তোমার সাথে বসে ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর করার।

এই সবের মাঝ থেকেই আমি খুজে নেবো কি ভাবে অতিবাহিত করবো অবসর সময় টাকে । ও হা তুমি তো জানো, নাতি আসছে আমার। সবাই বলে, এই ফাও টার উপর নাকি মায়া হয় বেশি। ওটাকে নিয়ে সময় টা ভালই কেটে যাবে। কি বলও।
তা হয়তো যাবে। তবে একবারও কি মনে হয় না সময় টা খুব দ্রুত পেড়িয়ে গেলো।
আসলে তাই। কে যেন বলেছিল, “ জীবন এতো ছোট ক্যেনে”। আজ এই আসন্ন সন্ধ্যায়, সূর্যের আলো নিভে আসছে। পশ্চিমের আকাশ লাল, আমি বারান্দায় একা। কি মনে হচ্ছে জানো?
কি?
আস্তে আস্তে অনেক গুলো ফুল তো ঝরে গেছে। আরও কিছু যাবার পথে, আমিও তাদের দলে। কোনদিন কি একবারও ভেবেছিলাম আমি একদিন অবসর প্রাপ্ত নাগরীক হবো, আমি সিনিয়র সীটিযেন হবো। আমি সিনেমা হলে, বাসে, ট্রেনের টিকিটে দশ পারসেন্ট ডিসকাউন্ট পাবো। রাস্তায় চলতে যেয়ে একজন কাছে আসে বলবে, দাদু আপনার রুমাল টা পরে গেছে। আর আমি চশমাটা দুবার মুছে, মাথাটা দুদিক ঘুরিয়ে দেখবো কোথায় পড়েছে রুমাল টা।
তাই আমি অথর্ব হওয়ার আগেই বেড়িয়ে পড়েছিলাম আমার অতীত কে খুজতে।
কি দেখলে?
তবে শোন? তার আগে বলও তুমি কে?

নাই বা জানলে আমি কে? আমি বাস করি তোমার মনের মাঝে। তোমার অন্তনিহিত শক্তি।

হাঁ বেড়িয়ে ছিলাম। অবসর নেয়ার আগে ভেবেছিলাম একবার খুজে দেখি ওদেরকে যাদের সাথে আমার ছোটবেলা কেটেছিল। তারও কি আমার মতো আজ অবসর প্রাপ্ত ?
খুজে পেয়ে ছিলে কি?
পেয়েছিলাম মীনু কে। আমার ছোটবেলার খেলার সাথী। এক্কা দক্কা খেলার সাথী। ছোট ছোট হাঁড়িপাতিলে মিছিমিছি রান্না করে বলতো, এই নাও, সব টুকু খেয়ে নাও। সেই মীনু যখন ওড়না গায়ে দিয়ে এসে একদিন বলল, মা, বারন করে দিয়েছে তোমার সাথে খেলতে।
আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, কেন?
সেই মীনু কে আমি খুজে পেয়েছিলাম সুন্দরপুরের এক গ্রামে। অবশ্য কৃতীত সব তৈয়েবের। ওর বাসায় উঠেছিলাম। বলেছিলাম, আমার আসার অভিপ্রায়।
সে বলেছিল, যা দেখবি, যা শুনবি তাতে করে তোর মন ভরবে না, বরং ব্যথাই পাবি। তোর চোখে রয়েছে তোর সেই ফেলে যাওয়া স্মৃতি। মাঝে যে অনেক জল গড়িয়ে গেছে সেটা তো তুই দেখতে পাসনি।
এই আমাকে দেখ। যে তৈয়েব কে তুই শেষ দেখেছিলি আমি কি সেই।

না। তুই সেই তৈয়েব না। তোর শ্যামলা রঙ টা আজ কালচে তে রুপ নিয়েছে। কপালে, গালে আচুলীতে ভরা, চোখের নিচে থলথল করছে জলের থলি। তোর সেই ঘন চুল আজ নেই বললেই চলে। এক কালে ফুটবল খেলায় তোর পারদর্শিতার অন্ত্য ছিলনা, সেই তৈয়েব আজ কাজ থেকে অবসর নিয়ে চা র দোকানে বসে আড্ডা দেয়। মোটা কাচের চশমা টাকে বার বার মুছতে হয়। দুরে হেটে আসা লোক টাকে ঝাপসা লাগে।

শুধু তাই নয়। আড্ডা দিতে আরম্ভ করেছিলাম চার জন মিলে। আজ দুজনে এসে ঠেকেছি। বলে তৈয়েব তাকাল আমার দিকে।

কাকে চাই?
বলে যে মহিলা টা এসে দাঁড়াল আমার সামনে তাকে আমি চিনতে পারিনি। রুগ্ন দুটো হাতে দুটো সোনার চুড়ি। ঢলঢল করছে। চোখের নিচে মনে হোল কে যেন কালো কালি লেপটে দিয়েছে। আমার দিকে তাকিয়ে রইল সে।
বললাম, মীনু নামে কেউ থাকে কি এখানে?
সে বলল, কেন? কি দরকার তার সাথে?
বললাম, দেখা করতে এসেছিলাম, ছোট বেলার বন্ধু। আমার নাম মিন্টু।
আর আমার নাম মীনু।
বড় দেরী করে এলে। কোথায় ছিলে এতদিন? তোমাকে আমি চিনতে পারিনি, তুমিও আমাকে চিনতে পারোনি। তোমার সেই ঠোটের নিচের হাসি টা হারিয়ে গেছে।
আর তোমার হারিয়ে গেছে সেই বড় বড় চোখ দুটো।
আমিও তো হারাবার পথে। বলে করুন দৃষ্টি দিয়ে তাকাল আমার দিকে।
কেন? কি হয়েছে।
রাজ রোগ। স্বামী চলে গেলো একরাতে, হার্ট অ্যাটাকে। আর আমাকে ধরলও এই রোগ।
এই বলে সে ভিতরে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো। হাতে একটা এ্যালবাম।
বলল, দেখো, আমার বিয়ের ছবি। দেখাতে দেখাতে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল।
আমি বললাম, ছেলে, মেয়ে—
বিধাতা দেইনি।
তাহলে কে দেখাশুনা করে।
আমার ভাই।
চিকিৎসা।
করিনি। কি হবে করে? কাড়িকাড়ি টাঁকা। কে দেবে? আর ভাল হবার নিশ্চয়তা বা কি? তাই যে কটা দিন আছি এই ভাবেই চলে যাবে। তুমি কি করছ?
কাজ থেকে অবসর নিতে চলেছি।
তুমি অনেক পালটিয়ে গেছো। মাথার চুলে কলপ দিয়ে কি বয়স টাকে লুকিয়ে রাখতে পারবে? কপালের রেখা গুলো প্রকট হয়ে উঠেছে। দেখেছ কি? তোমার চোখে মুখে কেনও জানি একটা বিষণ্ণতার ছাপ। তোমার সেই হাসিটা আমার মনে আজও গেঁথে রয়েছে। ওটাকে হারালে কি ভাবে?
ঝড় ঝাপটা তো অনেক গেছে হয়ত ঝড়ের দাপটে হারিয়ে গেছে ঐ হাসিটা। তবু ভাল লাগলো তুমি মনে রেখেছ সেই ছোট্ট বেলার হাসিটা।

তারপর ছোট ছোট কথা।
বিদায় কালে বললাম, হয়ত আর দেখা হবে না। কথা টা বড় মর্ম বিদায়ক, কিন্তু কি বলব বলও। এটাই তো চরম সত্য। তাই না?
হা, তাই। এবার এসো।

আমি আর তৈয়েব ফিরে এলাম। আসার পথে তৈয়েব বলল, মহী বেচে নেই, ওয়াহেদ অনেক আগেই চলে গেছে, সহীদুল্লাও যাওয়ার পথে, তবে তোকে একজনের কাছে নিয়ে যাবো চিনতে পারবি কিনা জানিনা।
ওর রহস্য আমি ভাঙ্গতে চাই নি। সে নিয়ে এলো উচু প্রাচীর দেওয়া এক দোতালা বাড়ীর সামনে। এইখানে এই বাড়ীর কথা আমার মনে পরে না।
জিজ্ঞাসা করলাম, এইখানে কি আগে এই বাড়ী ছিল।
না ছিল না, তোর মনে পরে কুসুমদের কথা। ওদের জমি দখল করে এই বাড়ী বানান হয়েছে। সে অনেক কথা, পরে বলব।

বেল বাজাতেই দারোয়ান এসে জিজ্ঞাসা করল, কাকে চাই?
সামসুদ্দীন সাহেব কে বলও, তৈয়েব আর মিন্টু এসেছে।
কে এই সামসুদ্দীন? জিজ্ঞাসা করতেই, তৈয়েব বলল, দেখ না, আগে চিনতে পারিস কিনা।

দারোয়ান ভিতরে নিয়ে এলো। ড্রয়াইং রুম দামী আসবাব পত্র দিয়ে নিখুঁত ভাবে সাজানো।
আমাদের কে বসতে বলে দারোয়ান ভিতরে চলে গেল। এক মিনিট, দুই মিনিট করে পনের মিনিট পার হয়ে গেলো।
আমার ধর্জের সীমানা পাড় হতেই বললাম, চল উঠি।
ঠিক সেই সময় মাথায় টুপি, গোলগাল, সাদা দাড়ি ওয়ালা এক ভদ্রলোক পাশের দরজা খুলে আসতেই আমার চোখ আটকিয়ে গেলো বা হাতের সোনার বালার দিকে।
তৈয়েবের দিকে চেয়ে, সরি দোস্ত, বলে কোলাকুলি সেরে আমার দিকে তাকাল।
তৈয়েব বলল, চিনতে পারছিস ওকে। তাকিয়ে রইল আমার দিকে, হঠাৎ চিৎকার করে বলে উঠল, মিন্টু না?
হা, তবে আমি তো—
কথা শেষ না হতেই আবারও চিৎকার করে বলল, মনে পরেনা ? তুই আমাকে মাঝে মাঝে অঙ্ক দেখিয়ে দিতি। আমি আসতাম গোপালপুর থেকে। মনে পরে?
আস্তে আস্তে আমার মনের পর্দায় সামসুদ্দীনের চেহারা ভেসে উঠল। হ্যাংলা পাতলা ছেলে। আমাদের সাথে পড়ত। মঝে মাঝেই আমাকে বিরক্ত করত ক্লাস শেষে। অঙ্ক, ফিজিক্স দেখিয়ে দিতে হতো। বন্ধুত্ত গড়ে উঠেনি।
ম্যাট্রিকে নকল করতে যেয়ে ধরা পরে। তারপর ওর খবর আর আমি জানি না। জানার কথাও নয়।
সেই সামসুদ্দীনের এই বাড়ী, দারোয়ান। আসবাব পত্র।
তা ইদানীং কি করছিস? ব্যাবসা করছিস বুঝি?
জিজ্ঞাসা করতেই দুপাটি দাঁত বের করে হেসে (একটা দাঁত নতুন বাধিয়েছে, চক চক করছে) বলল,
আমি এই জেলার রাজনৈতিক সংগঠনের প্রধান। হা, ব্যবসা যে নেই তা নয়, ওগুলো আমার ছেলেরা দেখে।
আমি অন্য দিকটা সামলাই।
অন্য দিকটা মানে?
জিজ্ঞাসা করতেই বলল, ও তুই বুঝবি না।
তা বেশ তো ভালই আছিস মনে হচ্ছে?
তা তোদের দোয়ায় একটা ইন্ডাস্ট্রি করতে পেরেছি। দুটো বাড়ী আছে। সংসারে অভাব অনটন নাই বললেই চলে।
তোরা বোস, তোদের জন্য খাবার আনতে বলি।
আমার মন চাইল না ওর ওখানে বসতে। বললাম, আজ আসি।
বেড়িয়ে এলাম।

আরও কাউকে খুজে বের করব কি? তৈয়েব প্রশ্ন করতেই বললাম,
না আর নয়। আবার ফেরার পালা। তবে একটা কথা বলি, নিতান্তই আমার কথা।
কি?
এই ছোট্ট জীবনের জন্য এত হিংসা, এত খুনাখুনি কেন?
এই সব নিয়েই তো জীবন। তা নাহলে তো সবাই সন্ন্যাসী হয়ে যেতো। তাতে আনন্দ কোথায়। কোণটা ভাল, কোণটা মন্দ বুঝবি কি ভাবে?
হয়তো তাই।
কথা শেষে বিদায় নিলাম ওর কাছ থেকে। এই হয়ত শেষ দেখা।

দেখে তো এলে, তা কি মনে হচ্ছে? নতুন জীবন টাকে মানিয়ে নিতে পারবে তো?
একটু সময় লাগবে। জীবন শক্তি তো আমার এখনও হারিয়ে যাই নি। মনের বল টাই প্রধান। ওটাকে আমার যে করেই হোক ধরে রাখতেই হবে। তা নাহলে ঐ দুস্টু টার সাথে আমি পেরে উঠব না। ওর মাঝে হয়ত আমি আবার নতুন জীবন ফিরে পেতে পারি। কি বলও, পাবো না ?
পাবে বৈকি?
তুমি শুধু এই প্রার্থনা করো।

You may also like

5 Comments

  1. “অবশেষে অবসর” দীর্ঘ চুয়াল্লিশ বছরের কর্মজীবনের অবশান।অতীত বর্তমান ভবিষ্যত।অতীতের স্মৃতিচারন তার মাঝে বর্তমানকে টেনে আনা এবং ভবিষ্যতে অবসর জীবনের পরিকল্পনা সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে লেখনীতে।

  2. Old is gold. You had a good life. I think sombody is comming soon who make you more hapier than everything inshallah. Enjoy your retierment!

  3. এবার একটা নতুন জীবন।প্রথমপ্রথম সাত সকালে ঘুম ভেঙে যাবে।তাড়াহুড়া করে উঠতে যাবে তারপরই মনে হবে না আজ আর উঠতে হবেনা,আজ কোন কাজ নেই। প্রথম প্রথম খুব কষট লাগে তারপর ঠিক হয়ে যায় একদিন। নতুন করে তৈরি হবে আর একটা জীবন।মুক্ত জীবন।বাধা বন্ধনহীন জীবন।প্রাথণা করিহাসি আনন্দে জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারো।

  4. Shasoner berajale nijeke na bedhe mon ja chay setatei ananda .Asha kori nuton jibone khub valo thakbe.Atit kkhono manuske valo rakhte pare na. Tai nijeke chorie dao sabar majhe.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *