শ্যামলী

  মানুষের মন কেন এতো সংকীর্ণতায় ভরা। কেন মানুষ ভাবতে পারেনা একটা মেয়ে আর একটা ছেলে পাশাপাশি হাঁটলে, হেসে কথা বললেই তাঁরা প্রেমিক প্রেমিকা নয়। তাদের সম্পর্ক অন্য কিছু। এইসব চিন্তা গুলো সেলিমের মাথায় যট পাকাচ্ছীল। কাল সারা রাত ঘুমাতে পারেনি সেলিম।

ওয়ার্ল্ড কাপ দেখছিল সেলিম  । আর্জেন্টিনা ভার্সেস করেসীয়া। আর্জেন্টিনার পক্ষে সে। আর্জেন্টিনা এক গোলে পিছিয়ে আছে। সেলিম উত্তেজিত। কোন ক্রমেই যেন আর্জেন্টিনা না হারে এই দোয়া করছিল। মধ্যে পথে উঠে যেয়ে এক কাপ কফি বানিয়ে এনেছিল।

আর্জেন্টিনার পায়ে বল। করেসীয়ার গোলের কাছে, ঠিক সেই সময়ে ফোনটা বেজে উঠল। শ্যামলীর ফোন।

এই সময়ে তার তো কাজে থাকার কথা। কেন কল করলো? ঠিক সেই সময় বলটাকে কিক করলো, কিন্তু না বলটা গোল পোস্টের পাশদিয়ে বেড়িয়ে গেছে।

ফোন টা উঠিয়ে হ্যালো বলতেই, শ্যামলী বলল, তুমি কি ব্যস্ত।

সেলিম না বলতেই, শ্যামলী উত্তেজিত ভাবে বলল, সময় হবে তোমার?

শ্যামলীর কণ্ঠস্বরেই সেলিম বুজতে পারলো, কিছু একটা ঘটেছে। খেলা টা আর দেখা হবে বলে মনে হচ্ছে না।

কেন কি ব্যাপার? এই অসময়ে – কথা শেষ হবার আগেই শ্যামলী বলে উঠল, তুমি আর আমাকে কল করবে না। আমিও না। আমিও তোমাকে কোন ভাবে কন্টাক্ট করবোনা, আর তুমিও করবেনা।

কথা গুলো শ্যামলী এতো তাড়াতাড়ি উত্তেজিত ভাবে বলে গেলো সেলিম বুঝে উঠতে পারছিলনা কি হয়েছে।

তা বলবে তো কি হয়েছে।

নীলা টেক্সট পাঠিয়েছে।

কি টেক্সট পাঠিয়েছে? আর নীলা তো তোমার ছোট বোন। সে কি এমন টেক্সট পাঠাল যার জন্য তুমি আমাকে কল করতে বাড়ন করছ, আর তুমিও আমাকে কল করবে না।

ও একটা ইডিয়েট। আমার ছোট সে আর ও কিনা বলে আমি খুব খারাপ কিছু করে বেড়াচ্ছি তোমার সাথে। ওর শ্বশুরবাড়িতে নাকি ও মুখ দেখাতে পারছে না। তাই সে চায় না আমি তোমার সাথে মেলা মেশা করি।

সেলিম কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তা তোমার আত্মীয় স্বজন যদি তাই চায়, তবে তাই হোক। কিন্তু ওরা কি জানে  তোমার আমার সম্পর্ক বড় ভাই আর ছোট বোনের মত।

ওটা বোঝার মত এতটা উদার মন ওদের নেই।

তাহলে নীলা কে বল কি সম্পর্ক তোমার আর আমার মাঝে।

কোন ইচ্ছা আমার নেই ওকে বলা। তার চেয়ে তুমি আর কোনদিন আমাকে কল এবং কোন রকম কন্টাক্ট করবে না।

তা হলে তো তুমি ওদের টাই মেনে নিলে। ওদের সন্দেহ টাকে ঠিক বলে প্রমান করে দিলে। এটা কি ঠিক করলে। এই বলে সেলিম চুপ করে রইল।

সেলিমের সাথে শ্যামলীর দেখা হয়েছিল এক বিয়ের আসরে। সেলিমের বন্ধুর ছেলের সাথে শ্যামলীর বোনের মেয়ে। শ্যামলীরা তিন বোন। শ্যামলীর বিয়ে হয়েছিল । এক ছেলে। আজ সে একাই।

বন্ধুই ডেকে এনে বসিয়ে ছিল ওদের টেবিলে। শ্যামলীর পাশেই। আড়ষ্ট তা কাটিয়ে উঠে সেলিম জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনার নাম টা জানতে পারি কি? বলে কাঁটা চামচ দিয়ে কয়েকটা লেটুস পাতা উঠিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল।

আমার নাম শ্যামলী। আপনি যদি মতীন ভাইয়ের বন্ধু হন, তবে আমার আর আপনার মাঝে বয়সের ব্যবধান বিশ বছরের কম হবে না। কাজেই আপনি আমাকে তুমি বলেই বলবেন।

শ্যামলীর চেহারা টা বাচ্চা সুলভ। কাজেই বয়স টা অনায়সে লুকিয়ে ফেলা যায়। সেলিমের হিসেব অনুসারে চল্লিশের কিছু উপরে। ওকে দেখে সেলিমের মনে পড়লো ওর ছোট বোন লতার কথা। বোনটা ছিল সেলিমের নেওটা। দাদা  দাদা বলে দাদার পিছনে ঘুরে বেড়াত। কোন কিছু চাইলে না বলতে পারতো না সেলিম।

মা বাবা দুজনেই বলত, বড় আস্কারা দিচ্ছিস তুই ওকে।

সেলিম বলত, এটুক তো ওর প্রাপ্য। পরের ঘরে গেলে ওটা হয়তো নাও পেতে পারে।

পরের ঘরে ওর আর যাওয়া হয়ে উঠেনি। সেলিম যখন লন্ডনে তখন একদিন খবর এসেছিল, ওর আদরের বোন টা নেই।

কি এক রোগে সে চলে গেছে। কেউ বলে মেনীনযাইটিস, কেউ বলে অন্য কিছু। ডাক্তারেরাও বলতে পারে না।

আজ শ্যামলী কে দেখে সেলিমের লতার কথা মনে হোল। ও আজ বেচে থাকলে শ্যামলীর মতন ই হতো।

আমি ড্রিঙ্কস আনতে যাবো, কারো কেছু লাগবে? বলে সেলিম উঠতেই শ্যামলী বলল, চলুন আমিও যাবো।

দুজনে এসে দাঁড়িয়েছিল ড্রিঙ্কসের কাউন্টারে।

কি নেবে তুমি?

পীনাকোলাডা। আপনি?

জীঞ্জারেল। একটা কথা বলি।

বলেন।

যদিও প্রথম দেখা তবুও বলি, তোমার মতো আমার একটা ছোট বোন ছিল, সে আমাকে তুমি বলে বলত।

বুজেছি। ঠিক আছে।

পার্টি শেষে সেলিম বিদায় নেবার কালে শ্যামলী বলেছিল, তোমার ফোন নাম্বার টা আর ফেবুকে কি নামে আছো নিতে পারি কি সেলিম ভাই?

ওটা যখন Unlisted নয় তখন না দাওয়াটা ভদ্রতার পর্যায়ে পড়বে বলে মনে হয় না। আর ফেসবুক তো সোশ্যাল মিডিয়া।

ফোন নাম্বার আদান প্রদানের পরে সবাইকে শুভ রাত্রি জানিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছিল সেলিম।

বেশ কিছুদিন গত হয়েছে। হঠাৎই বন্ধু আকরামের ডাকে এসেছিল Calgary থেকে। অনেকদিন থেকেই বলছিল, একবার ঘুরে যা এখান থেকে, ভাল লাগবে।

আকরাম কলেজ কালের বন্ধু। সিভিল ইনজিনিইয়ারিং এ পাশ করে ক্যানাডা তে চলে এসেছিল। তাও অনেক দিন আগে।

যোগাযোগ ছিল না। একদিন ফাসবুকের people you know খুজতে যেয়ে একটা ফটোর মাঝে আটকিয়ে গেলো সেলিম।

অনেকক্ষণ দেখার পর মনে হোল এতো আকরাম। এক কালে দহরম মহরম ছিল। জীবনের ব্যস্ততার মাঝে হারিয়ে গিয়েছিল।

ফেসবুকের মাধ্যমেই ফিরে পেয়েছিল আকরাম কে।

সকালে আকরামের বৌ মলিনার মচমচে ভাজা পরোটা আর সুজির হালুয়া দিয়ে নাস্তা টা ভালই লাগছিল। সেই সাথে বাহিরে ঝলমলে রৌদ।

কি সেলিম ভাই, হাত গুটিয়ে বসে আছেন কেন? আর একটা পরোটা উঠান। বলে মলিনা উঠিয়ে দিতে গেলে সেলিম বলে উঠল,

পাগল। একটাই যথেষ্ট।

আকরাম টিপ্পনী করে বললও, দেখছ না শরীর টা। আমার মত ভুঁড়িটা ও বানাতে পারেনি এই খাওয়া কনট্রোলের জন্য।

এবার কাউকে আনেন ঘরে। বলে মলিনা তাকাল সেলিমের দিকে।

সকাল টা মাটি করো নাতো? বলে উঠল আকরাম।

ঠিক সেই সময় সেলিমের ফোনটা বেজে উঠল।

শ্যামলীর ফোন।

খুব ঘুরে বেড়াচ্ছ, তোমার সুন্দর সুন্দর ছবি দেখলাম। আমাকে নিলে না কেন? আমার খুব দেখতে ইচ্ছে করে ঐ জাগা  গুলো।

বেশ তো, পরের বার যেদিকে যাবো নিয়ে যাবো তোমাকে।

কথা দিলে কিন্তু।

কথা দিলাম।

টুকি টাকি কথা শেষ করে রেখে দিতেই আকরাম জিজ্ঞাসা করেছিল, কে?

তুই তো লতাকে চিনতি, ওরই মতো আর একজন।

দুই দিন বাদে ফিরে এসে শ্যামলী কে কল করেছিল সেলিম। গলার স্বর নিচের দিকে।

কি হয়েছে?

বাসার ছাদ দিয়ে পানি পড়ছে। সাল কে খবর দিয়েছি। গাড়ী টায় ইঞ্জিন চেক সাইন দিচ্ছে। ছেলেটার বাস্কেট বল প্রাকটিস আছে। ভীষণ ডিপপ্রেস লাগছে।

শোন গাড়ীটা আমার এখানে রেখে আমার গাড়ী নিয়ে যাও। ওটার ব্যবস্থা আমি করব।

শ্যামলী আধো আধো কান্না গলায় বললও, তুমি ছাড়া তো আমার কোন পথ আছে বলে মনে হয় না। এক মাত্র তোমার সাথেই আমি মন খুলে কথা বলতে পারি। আমার কোন বড় ভাই নেই । দুলাভাই আমাকে খুব ভালবাসত। সে চলে যাওয়ার পরে এই প্রথম আমি তোমার কাছ থেকে সেই কেয়ারীং আর বড় ভাই এর ভালবাসাটা পেলাম।

শ্যামলী থাকে ছোট্ট একটা নিজেস্ব বাসায়। সিঙ্গেল মা। অনেক কষ্ট করে ছেলে টাকে মানুষ করছে। সেলিম একদিন বলেছিল, আচ্ছা শ্যামলী, কাউকে খুজে পাওয়ার চেষ্টা করছ কি?

করেছিলাম। কিন্তু তোমার সাথে তুলনা করলে আর এগোতে পারিনা। ওদের মাঝে তোমার মতো উদারতা নেই।

ভুল করলে। এসব ব্যপারে কারো সাথে তুলনা করতে নেই। একেক জনের একেকটা নিজেস্ব সত্ত্বা আছে। শুধু দেখবে সে তোমাকে আর তোমার ছেলে টাকে প্রাধান্য দেয় কিনা।

আচ্ছা সেলিম ভাই এতো সব জানো কি করে? তুমি তো একলা। কোনদিন তোমাকে জিজ্ঞাসা করিনি, একলা কেনও?

একলা ছিলাম না। যা চেয়েছিলাম, তা পেয়েও ছিলাম। কিন্তু গাঁটছড়া আর বাঁধা হয়ে উঠেনি। ঘোরাঘুরি করেছি দুজনে অনেক বছর।

তারপর?

তারপর একদিন আমার মোটরসাইকেলের পিছনে ওকে নিয়ে চলতে যেয়ে একটা বাস এসে ধাক্কা দিয়েছিল। ছিটকে যেয়ে পড়েছিলাম দুরে। মোটরসাইকেল টা চুরমার হয়ে গেলো। সেই সাথে সেও চলে গেলো। অনেক দিন লেগেছিল সুস্থ হয়ে উঠতে। এরপর আর ও পথে পা বাড়াইনি।

সরি, সেলিম ভাই।

এই ভাবে চলতে যেয়ে সেলিম পেয়েছিল হারিয়ে যাওয়া লতা কে ওর মাঝে। তাইতো একদিন কল করে বলেছিল,

নতুন মুভি এসেছে শারুখহ খানের, যাবে দেখতে?

দুজনে এসে হলে ঢোকার আগেই দেখা হোল শ্যামলীর ছোট বোনের বান্ধবী নীলুফারের সাথে। আড় চোখে দুজনের দিকে তাকিয়ে কুশল সংবাদ জিজ্ঞাসা করে এগিয়ে গেলো হলের দিকে।

নীলুফার কি জানিয়ে ছিল শ্যামলীর বোন কে সেলিমের তা জানা নেই। সেই সুত্র ধরেই আজকের এই বজ্রপাত।

সুন্দর একটা সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেলো শুধু মানুষের মনের সংকীর্ণতার জন্য। সেলিম চেষ্টা করেছিল শ্যামলীর সাথে যোগাযোগ করার। বলতে চেয়েছিল, ওদের কথাকে প্রশ্রয় দিওনা। সংকীর্ণ মনের লোকের সংখ্যাই বেশি।

নিজের মনকে তুমি চেনও। নিজের মনকে প্রশ্ন করো। ওদের কে বলও তোমরা যা ভাবো তা নয়। সুন্দর মনের মানুষ হও।

এই কথা গুলো সেলিমের আর বলা হয়ে উঠেনি।

তাই ছোট্ট একটা কাগজে লিখে ছিল,

যদি কোনদিন দেখা না হয়, তবে ভাল থেকো। সুন্দর মনের কাউকে নিয়ে সামনের পথ টা পেড়িয়ে যেও। আমার আশীর্বাদ রইল।

You may also like

3 Comments

  1. পৃথিবীতে সংকীর্ন মনের মানুষের সমখ্যায় বেশী তারা সব সম্পর্কের মধ্যেই অসুন্দর খোঁজে।তুমি এই বিষয়টাকে খুব সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছো।তবে শ্যামলীর উচিত এদেরকে পাত্তা না দিয়ে রুখে দাঁড়ানো।লেখাটা খুবই ভালো হয়েছে।

  2. আমরা বাইরে যতই আধুনিক হই না কেন মানসিক দিক দিয়ে আধুনিক হতে পারিনি। পৃথিবী যতই এগিয়ে যাক আমরা অনেক পিছনে পরে আছি।আর বাংগালী দের তো কথাই নেই।ভালো হয়েছে লেখাটা ।তবে ভালো লাগতো আরো শ্যামলী যদি প্রতিবাদ করতে পারতো।

  3. লেখাটা খুব সুন্দর হয়েছে , সবার মনটা সেলিমের মত যদি সুন্দর মনের মানুষ হতো তাহলে এই সমাজ কত সুন্দর হতো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *