অনির্বাণ হাঁটছিল অন্যমস্ক ভাবে। অফিস শেষে যে ট্রেন টা তার ধরার কথা ছিল সেটাতে যাবেনা ঠিক করলো। কেন, সে নিজেও জানেনা। বাসায় যাওয়ার তাড়া নেই। কোনদিন যে ছিল তাও নয়। আজ অস্বাভাবিক ভাবেই দেরী করছে সে। গতকাল পাওয়া চিঠি টা তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। শান্তি, শান্তি অনেক খুঁজে অনির্বাণের সন্ধান পেয়েছে। তাইতো লিখেছে সে,” আসতে পাড়বি একদিন আমার এখানে”।
সামনের কফি শপ টাতে বসে এককাপ কফি খেয়ে নেবে ভাবল অনির্বাণ। কফির পেয়ালায় চুমুক দিয়ে ফিরে গেল সে অনেক পিছনে।
ছোট্ট শহর। অনির্বাণদের বাসার পাশের বাসাটা ছিল শান্তিদের। বয়স তখন কত ? চার, পাঁচ। এক্কা দোক্কা খেলার সাথী। হারিয়ে যেতো দুজনে পুকুর পাড়ে। জাম গাছের তলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরা জাম তুলে খেতো। সারা মুখ হয়ে যেতো নীল।
শান্তি বলত,” অণু, চল যাই ওই শালিক পাখি টাকে ধরি।” শান্তি সবসময় মাতব্বরি করতো অনির্বাণের উপর। অনির্বাণও সেটা মেনে নিয়েছিল। হাত ধরাধরি করে দুবন্ধু একদিন খেলতে খেলতে বড় হয়ে গেল। অনির্বাণ ষোল, শান্তি পনেরো।
অনির্বাণ চলে যাবে দূর শহরে। শান্তি তাকে বলেছিল,” জানিস অণু, তুই চলে গেলে আমি একেবারে একলা হয়ে যাবো। অনেক কাঁদবো। তুই একমাত্র আমাকে বুঝতে পারতিস।” অনির্বাণ চোখ মুছে বলেছিল,” ভাবিস না, আমি তোর খোজ রাখবো।”
না, কথা সে রাখেনি। ভুলে গিয়েছিল সে শান্তি কে, মেতে উঠে ছিল নতুন জীবন নিয়ে, ছুড়ে ফেলে দিয়ে ছিল অতীত কে। কিন্তু আজ চিঠি টার দিকে তাকিয়ে চোখের কোণ টা ভিজে উঠল। আবারো পড়ল সে চিঠি টা। করুন ভাবে লেখা। “ পারবি অণু, পারবি কি একবার আসতে, আমাকে দেখতে।”
যাবে সে। ঠিকানা দেখল। কানাডার।
তিন দিনের ছুটি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল অনির্বাণ তার গাড়ী নিয়ে। টরেন্ট শহরের কিছু দূরে শান্তির ঠিকানা। অনির্বাণ যখন পৌছালো সূর্য তখন অস্তাচলে। বাড়ী চিনতে অসুবিধা হয়নি। দুরু দুরু বুক কাঁপছে। প্রায় বিশ বছর পরে শান্তির সাথে দেখা হবে। আনন্দ নয়, কোথা থেকে একটা ভয় তাকে গ্রাস করছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম কপালে। গাড়ীর আয়নায় চেহারা টা দেখে নিলো অনির্বাণ। নেমে এসে দরজায় টোকা দিতেই এক বয়স্ক ভদ্র মহিলা দরজা খুলে জিজ্ঞাসা করলো,” কাকে চাই?”
“ শান্তি আছে?” অনির্বাণ জানতে চাইলো।
“ আপনি বুজি অনির্বাণ?”
অনির্বাণ বুঝল সে এখানে অপরিচিত নয়।
“জী” শব্দ টা সে অনেকদিন পর ব্যবহার করলো।
“ আসুন” বলে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো ভদ্রমহিলা।
ছোট্ট ঘর,দুটো লাভ চেয়ার, তার সামনে কফি টেবিল, একটু দূরে সাধারণ একটা টুল। পাশে লম্বা আয়না। দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের ছবি। দেয়াল গুলোতে রংএর ছোপ পড়েনি অনেকদিন। অনির্বাণের মনে হোল ঘরটাতে দারিদ্র্যতার ছাপ।
উঠে যেয়ে রবীন্দ্রনাথের ছবির সামনে দাড়াতেই পাশের দরজা খুলে এলো ঘোমটায় মুখ ঢাকা এক ভদ্রমহিলা। ছিপছিপে শরীর। “ কেমন আছিস অণু”?
অনির্বাণ থমকে যেয়ে তাকালও ঘোমটা ঢাকা অতি পরিচিত অথচ অনেক দূরের মহিলার দিকে। গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না, পলক পড়েনা চোখে।
“ ঘোমটা সরাবি ? নাকি পর পুরুষের সামনে মুখ দেখাতে না করে দিয়েছে কেউ?” অনির্বাণের জিজ্ঞাসা।
এ কথার উত্তর না দিয়ে শান্তি বললো, “ শানু, সেই যে তুই চলে গেলি আর ফিরে এলি না, খোজ ও নিলিনা।”
“ আমি তার জন্য অনুতপ্ত। কি হয়ে ছিল আমার জানিনা, পিছনে ফেলে আসা দিনগুলি আর আমার মনের মধ্যে আসেনি। আমাকে ক্ষমা করিস।”
“ ওসব ক্ষমার কথা বাদ দে। তোকে ডেকে এনেছি একটা কাজে। সেটা বলবো পরে।”
অনির্বাণ বুঝতে চেষ্টা করলো শান্তি কি বলতে চাইছে। ওর মনে হোল উঠে যেয়ে শান্তির হাত টা চেপে ধরবে কিনা। যে ভাবে দুজন হাত ধরাধরি করে দৌড়িয়ে বেড়াতো। কোথায় জেনো সংকোচ, দ্বিধা।
শান্তি বলে ,” জানিস অনু, যে শহর তুই ছেড়ে এসেছিলি ওটা অনেক পালটিয়ে গিয়েছিল। মাস্তানদের উপদ্রব আরম্ভ হোল। তখন আমার উঠতি বয়স। স্কুলের শেষ বর্ষের ছাত্রী। বুঝতেই পারছিস -। আচ্ছা দেখ, আমি শুধু বক বক করছি। হোটেল ঠিক করে আসিস নিতো ?”
“না হোটেল ঠিক করিনি।”
“তা হলে এখানে থেকে যা। একটা ঘর আমার। তোকে এই ড্রয়াইং রুমের মেঝেতে থাকতে হবে, অসুবিধা হবে না তো? “ বলল শান্তি।
“ অত ফর্মালিটি করিসনাতো? তুই বল তোর কথা, আমি শুনতে এসেছি আর দেখতে এসেছি তোকে।”
অনির্বাণ তাকিয়ে ছিল শান্তির কাপড়ে ঢাকা হাতটার দিকে। মনে হলো সমস্ত শরীর টাকে সে কাপড়ে পেঁচিয়ে রেখেছে। কিন্তু কেন?
“ বল কি বলছিলি” অনির্বাণ ফিরে যেতে চাইল সেখানে, যেখানে কথা অন্যদিকে মোড় নিয়েছিল।
“ যা বলছিলাম, উঠতি বয়স আমার, তারপর দেখতে শুনতে খারাপ ছিলাম না। ঐ হোল আমার কাল। তারপর হিন্দুর মেয়ে আমি। স্কুলের পথে আসতে যেতে উতক্তা করেতে লাগলো মাস্তানরা। মাস্তান দের সর্দার একদিন আমাদের বাসাতে এলো। বাবা কে বললও সে বিয়ে করবে আমাকে। যদি রাজি না হই তবে উচিত শিক্ষা দেবে।”
বাবা তাকে বের করে দিয়েছিল বাসা থেকে। স্কুলে যাওয়া আমার বন্ধ হয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে থাকি।
“ আইনের আশ্রয় নিসনি কেন?” প্রশ্ন অনির্বাণের।
“ তুই কি পাগল হলি? ওরাই তো আইন, ওরাই সব। আমাকে যে বাসা থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাইনি সেটাই তো ভাগ্য।” বললও শান্তি।
বলল,” অনু, ভালই হতো, যদি নিয়ে যেতো আমাকে, তাহলে আজ তোকে ডেকে পাঠাতাম না। তুই অস্বস্তি বোধ করছিস না তো?”
“ কি যে বলিস ? বল তোর কথা।”
“বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। ভাবলাম ঝড় হয়ত থেমে গেছে। রহীমাদের বাসাতো তুই চিনতিস। ওখানে যাবো ঠিক করলাম। কাউকে কিছু না বলে বেড়িয়ে পড়েছিলাম। রাস্তার থেকে গলিতে মোড় নিতেই পড়লাম ওদের মুখোমুখি। ভয়ে আমার শরীর আড়ষ্ট হয়ে এলো। দেখলাম মাস্তানদের সর্দারের দুটো হিংস্র চোখ। এগিয়ে এলো। কোন কথা বলেনি। শুধু ঢেলে দিয়েছিল এক বোতল এসিড আমার মুখের পরে।”
অনির্বাণ শিউরিয়ে উঠল কথা শুনে। তারপর,—-
“ চীৎকার করে ওখানে লুটিয়ে পড়েছিলাম। যখন জ্ঞান হোল দেখলাম, হাঁসপাতালের বেডে শুয়ে। সমস্ত মুখ ব্যান্ডেজে বাধা। “ এই বলে শান্তি একটু থামল.
“ বল শানু, থামিস না” অনির্বাণ উৎকণ্ঠিত
শানু বলে,” অনু, মনে আছে তুই বলতিস আমার গালের সেই ছোট্ট তিল টা তোর খুব পছন্দ। সেটা হারিয়ে গেছে।”
অনির্বাণের চোখ দিয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। মুখে কোন কথা নেই। শান্তির
নিজের অজান্তে কখন যে ঘোমটা একটু সরে গিয়েছিল সে নিজেও জানে না। পাশের আয়নায় ফুটে উঠেছিল ঝলসে যাওয়া মুখটা। অনির্বাণের সারা শরীর কাটা দিয়ে উঠেছিল। চোখ ফিরিয়ে নিয়েছিল । তাকাতে পারেনি দ্বিতীয় বার।
“ শানু থাক বলতে হবে না। কি শাস্তি হয়েছিল ওই বদমাশদের?” অনির্বাণ জানতে চাইল।
শান্তি একটু হাসলো। শাস্তি, কোথায় শাস্তি? প্রমাণ হয়েছিল ওই সময় ওরা ছিল অন্য গ্রামে। তুই ভাবছিস আজ আমি এখানে এলাম কি ভাবে, তাইনা? এক জনের দয়ায়। আমাকে দেখেছিল হাসপাতালে। এসেছিল তার মা কে দেখতে। পাশের রুমে। পরিচয় হয়েছিল বাবার সাথে। শুনেছিল সব।
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে আমরা সেই শহর ছেড়ে অন্য শহরে বাসা বেধে ছিলাম। বছর না পেড়োতেই একদিন কামাল এসেছিল আমাদের বাসায়। বাবাকে প্রস্তাব দিয়ে ছিল। বাবা প্রথমে রাজি হয়নি। বলেছিল তাকে, “দয়া দেখাতে আসোনি তো? তুমি দেখেছ শান্তিকে? পারবে সহ্য করতে? তোমরা, আমরা এক গোত্রের নই। পারবে কি সে দন্ধ থেকে বেড়িয়ে আসতে?”
সে শুনেছিল। বলেছিল তার কোথা। নিয়েছিল আমাকে।
এখনো কিছু ভাল মানুষ আছেরে অনু। এই বলে শান্তি উঠে দাঁড়াল। বললও
“ চল খেতে বসি, সেখানে শেষ করবো সব কথা।”
অনির্বাণ জিজ্ঞাসা করলো,” তোর সেই দেবতা কোথায়?”
“ সব বলবো তোকে, আগে হাত মুখ ধুয়ে নে।”
খাবার টেবিলে বসে শান্তি বলে,” কি জানিস অনু, এখন মনে হয় উপরওয়ালা বলে কিছু আছে। তা না হলে আমার দেবতা যখন চলে গেল তখন তোর খোজ আমি পেয়ে গেলাম। আমার এক দরজা বন্ধ হোল আর এক দরজা খুলে গেল।
হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে ও চলে গেল একদিনের মধ্যে। রেখে গেল আমার তিন বছরের মেয়েকে। অনু, পারবি ? পারবি আমার অবর্তমানে অনন্যাকে মানুষ করতে? পারবি অনু?”
অনির্বাণ কথা দিয়েছিল। বলেছিল,” ভাবিসনে শানু, একবার ভুলেছিলাম, আর নয়।”
কয়েক বছর পাড়িয়ে গেছে। এক রোঁদরো ঝরা বিকেলে অনির্বাণ তার ড্রয়াইং রুমে বসে বই পড়ছিল, এমন সময় কোথা থেকে দুষ্টু মেয়ে টা কাকু কাকু বলে ঝাঁপিয়ে পড়ল অনির্বাণের বুকে, গালে গালে রেখে বললও,” তুমি না বলেছিলে জোন্স বীচে নিয়ে যাবে কাকুমনি?”