Can you give me a glass of water। মারগারেটের ডাক শুনে আহমেদ উঠে এলো। ড্রয়াইং রুমে বসে সদ্য আসা একটা মেডিক্যাল জার্নালের পাতা উল্টাচ্ছিল। যদিও ডাক্তারি প্রাকটিস ছেড়ে দিয়েছে আজ অনেক বছর হোল। তবুও এই জার্নাল গুলো পড়তে ভালই লাগে।
পানির গ্লাস টা এগিয়ে দিলো মারগারেটের হাতে। হাতটা ছোঁয়ালও কপালে। জ্বর দেখতে নয়, আদরের ভঙ্গিতে। মারগারেট ওর বা হাতটা দিয়ে চেপে ধরলও আহমেদের হাতটা। ঝাপসা চোখে বলল, আর কতদিন এইভাবে করে যাবে।
ও কথা বলতে নেই। ঠাণ্ডা লাগছে নাতো? বলে চাদরটা পায়ের উপরে আর একটু উঠিয়ে দিল।
ফেলীসীয়াকে চলে যেতে বলেছি। ও কাল সকাল আটটায় আসবে। তোমাকে একটু পরে দুধ টা গরম করে এনে দেবো। এই বলে আহমেদ ড্রয়াইং রুমে এসে বসলো।
জার্নাল টা আবারও উল্টাল কিন্তু মন বসলো না।
ড্রয়াইং রুমের দেয়ালে টাঙ্গানো অনেক আগে মারগারেটের সাথে তোলা ছবিটার দিকে তাকিয়ে ছিল আহমেদ। বয়স তখন কতো? তিরিশের কাছা কাছি। মিশিগানের এক হসপিটালে Residency করে আহমেদ।
ষাটের দশকের শেষে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে সেরা ছাত্র হয়ে বেড়িয়ে এসেছিল আহমেদ। আহমেদের মামা ছিল ডাক্তার। সেই খোঁজ নিতে বলেছিল। বলেছিল USIS(United States Information Services) যেয়ে জানতে কিভাবে আমেরিকান হসপিটালে কাজ নিয়ে যাওয়া যায়।
খোঁজ নিয়ে জেনে ছিল ECFMG দিতে হবে। দিয়ে ছিল। ভাল রেজাল্ট করে চলে এসেছিল মিশিগানের ঐ হাসপাতালে Residency নিয়ে। ঐখানেই পরিচয় মারগারেটের সাথে।
মারগারেট নার্স। একই ওয়ার্ডে দুজনের ডিউটি।
একদিন কাজের ফাকে আহমেদ ঘুমিয়ে পড়েছিল সোফাতে। মারগারেটের ছোট্ট একটা ধাক্কায় চোখ মেলে তাকাল আহমেদ। প্রতিদিন আঠারো ঘণ্টা করে ডিউটি করে শরীর ক্লান্ত হয়ে এসেছিল আহমেদের। ভেবে ছিল একটু চোখ টা বুজে নেই। একশো দশ নম্বর রুমের রোগী টাকে এই মুহূর্তে দেখতে হবে না। শেষ চার্ট টা সে দেখে এসেছে। নতুন কোন ওষুধ যোগ করতে হবে না। তাই ডাক্তারদের ওয়েটিং রুমে এসে চোখটা বুজেছিল।
ছুটি পাবে ভোর সাতটায়। তাও চার ঘণ্টার জন্য।
মারগারেটের ডাকে ধড়মড় করে উঠে বসল আহমেদ। মারগারেটের কথায় একশো চোদ্দ নম্বরের রোগীর শ্বাস নিতে অসুবেধা হচ্ছে। তাড়াতাড়ি যেতে হবে। রাতে ডাক্তার থাকে না। রেসিডেন্ট দিয়ে রাত টা কাভার করে।
রোগীকে দেখে অক্সিজেন মাস্ক আর লেসীক্সের পরিমাণ টা বাড়িয়ে দিতে বলে বেড়িয়ে এলো আহমেদ।
বাহিরের কর্নারের জানালার কাছে এসে দাঁড়াল সে।
বাহিরে জ্যোৎস্নার আলো।
ফিরে গেলো বহু পিছনে, মনে পড়ল একসময় ছাত্র থাকা কালিন হঠাৎ করেই একদিন অনন্যাকে দেখেছিল করিডোরে দাড়িয়ে থাকতে। এমন করে কোন মেয়েকে দেখেনি সে।
কি জানি কি হয়েছিল সেদিন। অনন্যার চেহারা সে ভুলতে পারেনি। রুমমেট কে বলেছিল।
রুমমেট প্রথমে বুঝে উঠতে পারেনি। আহমেদ করবে প্রেম। অবিশ্বাস।
বলেছিল, বন্ধু, হৃদয়ে দুব্বা গাছ জন্মেছে তাহলে। হাওয়া বইতে শুরু করেছে।
গল্প লেখার চেষ্টা করেছিল। চেষ্টা করেছিল অনন্যা কে নিয়ে লিখতে। দুই একটা কবিতার বই পড়ে সে ভেবে ছিল সাহিত্যিক হয়ে গেছে।
জীবনানন্দ দাশকে কোট করে,
“ডালিম ফুলের মতো ঠোঁট যার- রাঙা আপেলের মতো লাল যার গাল, চুল তার শাওনের মেঘ—আর আঁখি গোধূলীর মতো গোলাপী রঙ্গীন, আমি দেখিয়াছি তারে ঘুম পথে- স্বপ্নে- কতদিন”। সাথে আরও কিছু নিজস্ব লেখা। সব মিলিয়ে একটা চিরকুট তৈরী করেছিল।
ছুরি কাচি চালাতে যার হাত কাপেনি, আর আজ ছোট্ট একটা চিরকুট দিতে হাতের কাপন থামানো দায়। তবুও ক্লাস শেষে বের হয়ে দেখল অনন্যা দাড়িয়ে আছে দুই বান্ধবীর সাথে। আহমেদ এগিয়ে আসতেই অন্য দুই বান্ধবী বাই বলে চলে গেলো।
মেয়েদের সাথে কথা বলতে আহমেদ মোটেই তুখর নয়। সে আছে লেখাপড়া, বিভিন্ন দেশের খবরাখবর নিয়ে ব্যাস্ত।
শিক্ষকদের প্রিয় পাত্র সে। প্রেমের ব্যাপারে নিতান্তই অনভিজ্ঞ।
আহমেদ এগিয়ে আসতেই অনন্যাই প্রথমে বলেছিল, কেমন আছেন আহমেদ ভাই। বলে অনন্যা আরও এগিয়ে এলো আহমেদের কাছে।
আহমেদ পরিচিত সবার কাছে। পরিচিত অসাধারণ মেধাবী ছাত্র হিসাবে।
আহমেদের কপালে কুচিকুচি ঘামের রেখা। হাতে ধরা চিরকুট টার পাশ টা ভিজে গেছে।
আপনাকে খুব নার্ভাস লাগছে আহমেদ ভাই। সব ভালত?
একটু নার্ভাস, সামনে পরীক্ষা কি না। তাই।
এই পর্যন্ত। চিঠি টা আর দেওয়া হয়ে ওঠেনি। প্রেমের সমাধি সেখানে।
“ কফি টা খাও, ভাল লাগবে”।
ফিরে তাকালও আহমেদ। মারগারেটের হাতে কফির কাপ। তাকাল মারগারেটের চোখের দিকে। অনেকদুরে যার চোখের মাঝে খুজতে চেয়েছিল নিজেকে। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। হয়ে ওঠেনি তার নিজের ভীরুতার জন্য। আজ যেন তাই খুজে পেলো
মারগারেটের চোখে।
অনেকদিনই তো সে মারগারেটের সাথে কাজ করেছে। কিন্তু এমন ভাবে তো দেখেনি তাকে। দেখেনি তার সোনালী চুল, নীল চোখ। এসব সবই তো আগেও দেখেছে, আজ কেন তা ভিন্ন মনে হোল। কেন তার হাতের ছোঁয়ায় সমস্ত শরীর বীনার ঝংকারে ঝংকৃত হোল।
কফিটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে রইল মারগারেটের দিকে।
কিছু বলবে?
“আজ তোমাকে অন্য রকম লাগছে ম্যাগ”। এমন ধরণের কথা সে কখন বলেনি কাউকে। আজ কেনও? তবে কি? নিজের মনেই প্রশ্ন করল সে।
কি রকম লাগছে? আগলি?
না তা নয়। কি যেন দেখছি তোমার মাঝে যা আগে কখন দেখেনি। — এই বাচালতা কেনো এলো তার মাঝে। কথার ফুলঝুরি আগে তো ফোটেনি। তবে আজ কেনও?
পরদিন মারগারেট কে না দেখে জিজ্ঞাসা করেছিল লিজ কে। শুনল তার আজ ছুটি। কেমন যেন একটা অস্থিরতা মনের মধ্যে বিচরণ করতে লাগল। আজ পাঁচটায় সে বেড়িয়ে যাবে হাসপাতাল থেকে। ম্যাগের সাথে বসে কফি খেলে মন্দ হতো না ভেবে লিজের কাছ থেকে ফোন নাম্বারটা নিলো। কয়েক বার ডায়েল করতে যেয়ে রেখে দিল।
দ্বিধা, দন্দের মাঝে সে। ম্যাগের নীল চোখ টা ভেসে ওঠে তার মনে। ফোনটা বের করলো আহমেদ। আর দ্বিধা নয়।
ফোন করা হলনা। শুনতে পেলো মাইক্রোফোন বলছে, ডক্টর আহমেদ পিক আপ এক্সটেনশন ২০৫৪।
হ্যালো,
এতো মেঘ না চাইতেই জল। ওপাশে ম্যাগের কণ্ঠস্বর।
“ তোমার তো আজ পাঁচটা পর্যন্ত কাজ তাই না?”
হাঁ, কেনও?
আহমেদ তার নিজের দুর্বলতা কে এই মুহূর্তে প্রকাশ করতে চাইল না। হঠাৎ করে সে এতো সুন্দর খেলা কবে থেকে খেলতে শিখল তা নিজেই ভেবে পেলোনা।
–কাজের শেষে আসবে কি মেইন ষ্ট্রীটের কফি শপে। বিকেল ছয়টায়। কিছুক্ষণ সময় কাটান যাবে। অবশ্য তুমি যদি ব্যস্ত না থাকো।
আহমেদ ভেবে পেলনা কি ভাবে মারগারেট তার মনের খবর পেলো। তাকে আর এগিয়ে যেতে হোল না, সেই তোঁ এসে ধরা দিল।
আসব। ঠিক ছয়টায়। বলে ফোন টা রেখে এগিয়ে গেলো একশো বারো নম্বর রুমের রোগী কে দেখতে।
ঠিক ছয় টায় কফি ডিলাক্সের সামনে এসে দেখল মারগারেট দাড়িয়ে আছে। লাল স্কারটের সাথে গাড় নীল টপস। সোনালী চুল গুলো উঁচু করে বাঁধা। গলায় সাধা পার্লের নেকলেস। মনে হোল এতো সেই মারগারেট নয়, যাকে সে প্রতিদিন দেখে।
হাই! বলতেই মারগারেট এসে আহমেদের ডান গালে চুম দিলো।
ইয়াং ছাত্র দের আড্ডা খানা এই কফি ডিলাক্স। কোনায় একটা টেবিল নিয়ে বসলো ওরা দুজন। কথা আর খাওয়ার মাঝে মারগারেট আহমেদের হাতের উপর হাত রেখে তাকাল ওর দিকে। আহমেদ ওর আর একটা হাত টেনে নিলো ওর হাতের উপর।
সেই শুরু।
দুটো বছর কোথা দিয়ে কেটে গেলো দুজনের কেউ বুজতে পারলো না। একে অন্যনের মাঝে মিশে গিয়েছিল।
আহমেদর Residency শেষ। পরীক্ষা দিয়ে সে এখন ডাক্তার। নামের শেষে এমডি।
ঠিক সেই সময় দেশ থেকে খবর এলো মার শরীরে খুব খারাপ। এখনি এসো।
মারগারেট কে বলতেই সে বলল, যাওয়ার আগে আমাদের শুভকাজটা সম্পূর্ণ করে গেলে হয় না। আমিও না হয় তোমার সাথে যাবো। দেখবো তোমার মা কে।
এই ভয় টাই সে করছিল। আজও পর্যন্ত সে মা কে জানায় নি। মা সেকেলে। মেনে নেবে কিনা জানে না। বাবা বেচে থাকলে অসুবিধা হতো না।
বলল, থাক না, এই মুহূর্তে তাড়াহুড়া করে নাই বা করলাম।
মারগারেট আর কোন কোথা বলে নি। শুধু জেনে নিয়েছিল এখান থেকে দেশে যাওয়ার রুট কোণটা। কোথায় Lay over.
আহমেদ বলেছিল লন্ডনে বন্ধুর বাসায় দুদিন থেকে তারপর দেশের দিকে পাড়ি দেবে। বন্ধুর ঠিকানা টা মারগারেট নিয়ে রেখেছিল।
যথা সময় বিদায় দিয়ে মারগারেট ফিরে এসেছিল তার বাসায়।
সকালে দুই বন্ধু চার টেবিলে বসে পুরানো দিনের ঘটনার স্মৃতি মন্থন করছিল।
টিং টিং শব্দ। দরজায় কে যেন বেল টিপছে।
মহী এগিয়ে যেয়ে দরজা খুলতেই, মহিলা জিজ্ঞাসা করল, আহমেদ আছে?
আপনি?
মারগারেট।
মারগারেট? মহী জানে মারগারেট কে।
আসুন, আসুন। বলে নিয়ে এলো ডাইনিং রুমে।
আহমেদের কিছুটা সময় লাগল বুঝে উঠতে।
তুমি? এখানে।
হাঁ, এলাম, ভেবে দেখলাম একা থাকা আমার হবে না। তোমার সাথেই আমি দেশে যাবো। ওখানেই আমাদের বিয়ে হবে।
কি বলও?
আহমেদ চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। মাথা ঠিক মত কাজ করছে বলে মনে হোল না।
সমাধান করে দিল মহী।
কোন চিন্তা নেই, এই লন্ডনেই তোমাদের বিয়ে দিয়ে দেবো আমি। এখান থেকে তোমরা স্বামী স্ত্রী হয়ে দেশে নামবে।
তাই হোল। ধুমধাম না হলেও দুই একজন মহীর বন্ধুসহ আহমেদ- মারগারেটের বিয়ে হয়ে গেলো সেইদিনই।
এ যেন এক রুপকথা।
দুরুদুরু বক্ষে মা র সামনে এসে দাড়িয়ে ছিল। মা দুজন কে আশীর্বাদ করেছিল। চলে যাওয়ার সময় শুধু এইটুকুই বলে ছিল। তোমরা এ দেশেই থেকে যাও এই কামনা করি।
আহমেদ আর মারগারেটার আর ফিরে যাওয়া হয়নি। বড় একটা হাসপাতালে আহমেদ চাকরি পেলো। মারগারেট সংসার নিয়ে ব্যস্ত রইল।
বছর ঘুরতেই কোলে এলো ইব্রাহীম। সাদা কালো মিলিয়ে ইব্রাহীম দেখতে হোল এক মিষ্টি সোনার টুকরা। আহমেদের জান। কাজ থেকে এসে ওকে নিয়েই মত্ত থাকে।
দিন যায় রাত আসে এমনি করে অনেক অনেক বছর কেটে গেলো। ইব্রাহীম এখন যুবক।
একদিন আহমেদ হসপিটাল ফিরলে মারগারেট বলল, জানো আমার না কতো দিন থেকে Bowel Movment টা ঠিক মতো হচ্ছে না। সেই সাথে bladder এ প্রবলেম মনে হচ্ছে।
প্রথম প্রথম খুব একটা গুরুত্ত দেই নি আহমেদ।
কিন্তু ক্রমেই মারগারেট বুজতে পারে আগের মতো আর এনার্জি নাই। Mental depreesion। মুখএ শার্প pain অনুভব করে। মাঝে মাঝে চোখে ঝাপসা দেখে।
আহমেদ ডাক্তার, সব শুনে বুজতে পারে এটা স্বাবাভিক নয়।
নিয়ে গিয়েছিল Specialistর কাছে।
অনেক অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে ডাক্তার বলল, “It’s a symptoms of MS,” তুমি তো ডাক্তার তুমি জানো এর কোন চিকিৎসা নেই। শুধু সেবা করা ছাড়া।
সেই থেকে আহমেদ সেবা পরে চলেছে মারগারেট কে। বুজতে দেয় না তাকে। ছোট বাচ্চার মতো আগলিয়ে রাখে।
ইব্রাহীমের বিয়ে দিয়ে ছিল ধুমধাম করে। কিন্তু টেকেনি।
আহমেদের বয়স আজ পড়ন্ত বেলায়।
মাঝে মাঝে ভাবে মারগারেট তাকে অনেক দিয়েছিল। সমস্ত সংসারটা সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছিল। কাজ থেকে এলে মনে হতো সে যেনও এলো এক শান্তির নীড়ে। সেই শান্তির নীড় আজও আছে।
শুধু সে বসে আছে হেলান দিয়ে। তাকিয়ে থাকে আহমেদের দিকে। আহমেদ তাকে বই পড়ে শোনায়।
ফেলে আসা দিনের ছবি গুলো দেখে একসাথে। হাতে হাত রাখে।
রাতে ওর ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলে, “ এবার তোমার ঘুমানোর সময় হোল। ম্যাগ।“
4 Comments
সুন্দর তোমার লেখনী শক্তি।খুব ভালো লাগলো।
Fantastic!It seems like real story. Valo legese.
খুব সুন্দর কাহিনি পড়ে ভালো লাগলো , পড়ে মনে হয় real story
Loved it,