রাশিয়ার পথে ২

রাশিয়ার পথে রওয়ানা দিলাম আমরা চার জন। আমি, জীবু, দোজা ভাই, আর আন্না আপা। মস্কো তে যেয়ে মিলবো খুরশেদ ভাই আর ভাবীর সাথে। ওরা যাবে এরোফ্লটে। আমাদের এয়ার ফ্রান্স। প্যারিস হয়ে মস্কো।

রাত নয়টা পঞ্চান্ন তে ফ্লাইট। এয়ার পোর্টে পৌছে দিল ইসাক ভাই আমাকে আর জীবুকে।

তখন সন্ধ্যা সাতটা।

দোজা ভাই তখনও এসে পৌছায়নি। দশ মিনিটের মাথায় এসে গেলো।

চেক ইন আগে করা হয়নি। সময়ের অভাব। ব্যস্ততা।

যথারীতি মালপত্র উঠিয়ে দিলাম। সীট গুলো একসাথে পাওয়া গেলনা। তবুও মন্দের ভাল। সামনে দুজন পিছনে দুজন।

সিকিউরিটি পাড় হয়ে গেটের কাছে এলাম। বেশ কিছু লোক বসে আছে। বাহির থেকে খাবার কিনে এনে ছিলাম। ভেতরে ওরা ডিনার দেবে দেরীতে।

যথা সময়ে ডাক পড়ল। মালপত্র উপরে রেখে বসতে যেয়ে মনে হোল সিটের আয়তন একটু কমিয়ে দিয়েছে। আমার মতো পাতলা চিকন মানুষেরও বসতে অসুবিধা। পা রাখার জায়গা কম।

সাত ঘণ্টার পথ। কোন রকমে কষ্ট করে বসে পড়লাম। এমনিই আমার ঘুমের প্রবলেম। তার উপরে প্লেনে। কি আর করা। আমি আর দোজা ভাই পাশাপাশি। গল্প করতে করতে কিছুটা সময় পাড় করে দাওয়া যাবে।

সামনের ছোট টিভি টা নিয়ে কিছুক্ষণ খেলা করলাম। নাহ, ভাল কিছু নাই।

সময় মতো প্লেন আকাশে উড়ল। ভাবতে অবাক লাগছে। মস্কো যাচ্ছি। কোনদিন ভাবিনি। আমার ভ্রমণ খাতায় ঐ নামটা ছিলনা। ছেলে মেয়ে বার বার করে বলে দিয়েছে, সাবধানে ওখানে চলতে। কেউ অনুসরণ করছে কিনা খেয়াল রাখতে। হাজার হলেও রাশিয়া।

এয়ার হস্টেসরা ব্যাস্ত রাতের খাবারের তদারকি নিয়ে। এরই মধ্যে এক জন এসে আমার হাতে কোসার খাবারের একটা বাক্স ধরিয়ে দিল। ইন্সট্রাকশন দেওয়া ছিল হালাল খাবারের। আমার কোসার, অন্যদের এলো মুসলিম খাবার। উনন থেকে কেবল নামিয়ে এনেছে মনে হোল। অত্যন্ত গরম। অনেক কষ্টে প্যাকেট খুলে মুখে দিয়ে বুঝলাম আজ রাত টা উপোষ করেই কাটাতে হবে।

দোজা ভাই এর পাত্রেও আহা মরি কিছু নয়।

অগত্যা এক গ্লাস পানি খেয়ে চোখ টা বুজার চেষ্টা করলাম। হোল না।

বাকি সময় টুকু আমি আর দোজা ভাই গল্প করে কাটিয়ে দিলাম। জীবু, আন্না আপা ঘুমিয়েছে, শব্দে তার আভাস পেলাম।

ছয় ঘণ্টার ব্যবধানের জন্য সকাল হয়ে এলো খুব তাড়াতাড়ি। ক্যাপ্টেন ঘোষণা দিলো আর পনেরো মিনিটের মধ্যে আমরা প্যারিসে অবতারণ করছি। রৌদের আলো এসে পড়েছে জানালা দিয়ে।

সকাল এগারটায় আমরা নামলাম চার্লস দ্য গোল এয়ার পোর্টে।

মাত্র দের ঘণ্টার মধ্যে আমাদের কে আর একটা প্লেনে উঠতে হবে মস্কোর পথে।

তড়িঘড়ি করে সিকিউরিটি পার হয়ে গেটে এসে দাঁড়ালাম। প্লেন সময় মতো ছাড়বে লেখা আছে।

সময়ের ব্যবধান প্যারিস মস্কোর মধ্যে মাত্র এক ঘণ্টা।

মস্কোতে পৌছাতে লাগবে প্রায় চার ঘণ্টা।

মস্কোতে এলাম বিকেল ছয়টায়। ভাবছিলাম ইমিগ্রাশেনে কি না কি হয়। ভিসা মাত্র সাতদিনের দিয়েছে। যেদিন এন্ট্রি করব ঠিক সেইদিন থেকে যেদিন চলে যাবো ঠিক সেই দিন পর্যন্ত।

 কি অদ্ভুত তাই না? যদি এর মাঝে অঘটন কিছু ঘটে, তাহলে। এই চিন্তা মাথায় যে আসেনি তা নয়। এসেছিল।

মস্কো এয়ারপোর্ট আহা মরি কিছু মনে হলনা। নিতান্তই সাদাসিধে। আটপৌরে বলা যায়।

সবকিছু শেষ করে বাহিরে এসে দেখলাম Gate1 ট্রাভেলের লোক বড় একটা ব্যানার নিয়ে দাড়িয়ে আছে। আমরা কাছে আসতেই বলল, আরও তিন জনের জন্য ও অপেক্ষা করছে। সব মিলিয়ে আমাদের দলে আমরা আঠাইশ জন।

বাকীরা এসে যোগ দিতেই  ট্রাভেল এজেন্টের লোক টা নিয়ে এলো বাসের কাছে। বাসে উঠার আগে আমরা চারজন মিলে সেলফী উঠালাম বাসটাকে নিয়ে।

যাত্রা শুরু। হাসি হাসি মুখ আমাদের।

সূর্য তখন অস্ত গেছে।

আমাদের গন্তব্য স্থান Courtyard Moscow City Center, Voznesensky Pereulok. Moscow.

গাড়ী চলতে শুরু করেছে। ঝলমলে আলোতে সাজানো নয়। একটু মনঃক্ষুণ্ণ আমি । জীবুকে বললাম, দেখে মন ভরছে না।

বলল সে, হয়তো চলতে চলতে আসবে কিছু যা দেখে আপনার মন ভরবে।

হয়তো তাই।

রাস্তায় গাড়ীর ভিড়। লোকেরা কাজ শেষে বাড়ী ফেরার পথে। আমাদের ওখানকার মতো। পনের মিনিট চলার পর এলাম আলোয় আলোকিত রাস্তায়। এমনই তো আমি চেয়েছিলাম। প্রশস্ত রাস্তা। দুই পাশে মার্সেডিস, বিএমডবলুর ডিলারশিপ।

কম্যুনিজম বাতিল।

চওড়া ফুটপথ। মডার্ন সাজে সজ্জিত হয়ে হাঁটছে অনেক ইয়াং ছেলে মেয়েরা।

গাড়ী মোড় নিয়ে ঢুকল একটা ছোট রাস্তায়। দুই পাশের দালান ইউরোপিয়ান ধাঁচে তৈরী। নিচের তালায় বিভিন্ন ধরনের দোকান। কিছু রেস্তোরা। চওড়া ফুটপথের পরিবর্তে দুজন পাশাপাশি হাটা যায় এমন তড়ো।

গাড়ী এসে দাঁড়ালো আমাদের হোটেলের সামনে।

এঁকে এঁকে আমরা নেমে এলাম। আমাদের কে স্বাগতম জানালো আমাদের গাইড গেলীনা। নিতান্তই সাধামাটা  কাপড় পরনে। বয়স বোঝা মুশকিল। কোঁকড়ান চুল কিছুটা ছেড়ে দেওয়া, কিছুটা উপরে বাঁধা।

ডাক দিল আমাদের কে।

সে মাঝে, আমরা চতুর্দিকে।

“তোমাদের ডিনার রেডি। রুমে যেয়ে হাত মুখ ধুয়ে, পনেরো মিনিটের মধ্যে ডিনার রুমে চলে এসো”। বলে তাকালও আমাদের দিকে।

একটু এগিয়ে এসে বলল, তোমরা তো ভেজিটেরিয়ান, তাই না?

দোজা ভাই বলল, মাংস বাদে অন্য সবকিছু আমাদের জন্য বরাদ্দ করতে পারো।

ঠিক আছে, বলে সে চলে গেল।

রুম গুলো আমাদের নিচের তালায়।

জীবুর রুমের কাছে আন্না আপাদের রুম। আমার টা একটু দুরে।

কোন রকমে হাতমুখ ধুয়ে এসে দাঁড়ালাম হোটেলের চত্বরে। ওরা তখন আসেনি।

চারিদিক তাকিয়ে দেখছিলাম। অনেক উচু সিলিং। কাঁচে ঘেরা। সকালে সূর্যের আলো এসে পড়বে এই কাচ ভেঙ্গে। কালকের আবহাওয়া দেখিনি। ভাল যেন থাকে এই কথা ভাবতে ভাবতেই জীবু, দোজা ভাই, আন্না আপা এলো।

চল, বলে দোজা ভাই এগিয়ে গেলো।

ডাইনিং রুমে ঢুকতেই দেখলাম, খুরশেদ ভাই আর ভাবী। ঐ টেবিলে আরও কয়েকজনের সাথে উনারা।  উনারা এসেছেন দুপুরে।

পাশের টেবিলটাতে আমরা চারজন।

ওয়াটার সুপ এনে দিয়ে গেলো। স্বাদ মন্দ না।

“সারাদিন কি করলেন”? জিজ্ঞাসা করতেই খুরশেদ ভাই বলল, টানা ঘুম দিয়েছি। রীলাক্স। আপনার ভাবীর একটু ঠাণ্ডা লেগেছে মনে হচ্ছে।

ঔষধ পত্র আছে তো?

আছে, নিয়ে এসেছি। সাবধানের মার নেই। বলে উনারা উঠল।

গেলীনা বলেছে খাওয়া শেষে চত্বরে আসতে। আগামীকালের প্রোগ্রাম বলবে।

মাছ দিয়ে তৈরী ডিশ টা শেষ করে আমরা উঠে পড়লাম।

অনেকে এসে গেছে।

গেলীনা বলল, কাল আমাদের অনেক প্রোগ্রাম। সকাল নয় টায় এখানে হাজির হবে।  বাস ছেড়ে যাবে নয়টা তিরিশ মিনিটে।

ভীষণ ক্লান্ত আমরা।

কয়টায় নাস্তা করতে আসব? জিজ্ঞাসা করতেই দোজা ভাই বলল, সাড়ে সাতটায়।

আমার আর খুরশেদ ভাই এর রুম কাছাকাছি।

ওদেরকে বিদায় জানিয়ে আমরা পা বাড়ালাম আমাদের হল পথে।

You may also like

4 Comments

  1. তোমার সাথে মস্কোর মাটিতে পা রাখলাম আমিও।শুরু হলো তোমার চোখ দিয়ে সবকিছু দেখা।ভালো লাগলো লেখাটা।

  2. খুব সুন্দর হয়েছে মস্কোর কাহিনির লেখেটা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *