হঠাৎ আলোর ঝলকানি দিয়ে গেল একটা দিন। আনন্দ হাসি গানে ভরপুর একটা দিন। কতদিন এমন আনন্দ হয়নি। কতদিন এমন ভাবে হাসিনি। হাসি তো আর আসে না। আনন্দ তো আর আমাকে হাতছানি দেয় না। পুরো বাড়ি জুড়ে আমার বিষাদ। বিষাদ আমার আস্টেপৃস্টে জড়িয়ে রেখেছে। বিষাদই আজ আমার নিত্যসঙ্গী। বিষাদই আজ আমার প্রিয় বন্ধু।
কতদিন কতদিন হোল সে আমাকে ছেড়ে গেছে। দিনগুলি একটি একটি করে আমার প্রাণের উপর দিয়ে চলে গেছে। একটি একটি দিন, হ্রদয়ে আমার বিষাদের পাহাড় তৈরি করে দিয়ে গেছে। আহা বিষাদ । বিষাদ এখন আমার ভাল লাগে।
এরই মধ্যে হঠাৎ একটা দিন। হঠাৎ সেদিন ওরা এসেছিল কলকল করতে করতে। আমার নীস্তব্দ বাড়ীটা হঠাৎ করে জেগে উঠেছিল। জেগে উঠেছিল ওদের কোলাহলে। ওরা এসেছিল একসাথে, এসেছিল আমার ভেতরের নিঃস্বপ্রভো আলোটাকে সপ্রতিভ করতে। হাসির বন্যা বহিয়ে দিয়েছিল। প্রাণ পেয়ে ছিল আমার ঘুমিয়ে পরা বাসাটা। এসে ছিল শেলী, আমিন, সালিমা- ইউসুফ, ফাতেমা- সাইদ ভাই। এসেছিল জীবু বিয়েন, জিজ্ঞাসা করেছিল,” ওরা কবে আসবে শাফি ভাই, আপনের ঘরে উনন জ্বলেনা অনেক দিন। আমিই না হয় জ্বালিয়ে ওদের নাস্তার ব্যবস্থা করবো।”
সেই কাঁক ডাকা ভোঁরে উনি এসেছিলেন , বলতে হয়নি কিছু, নিজের হাতেই তুলে নিয়েছিলেন সব কিছু। জিজ্ঞাসা করে ছিলাম “ আমি কি কোন সাহায্যে লাগতে পারি.”।
“ না, আজ আপনি আনন্দ করবেন ওদের সাথে, এ দিকটা সামলাবো আমি”।
মেয়ে আমার বলেছিল,” আব্বু, লাঞ্চ এর ব্যবস্থা আমি করবো, তুমি ভেবোনা, ম্যাডিটেরিয়ান খাবার নিয়ে আসবো, তুমি শুধু ওদের সঙ্গ দেবে। এসেছিল সুষমা আর রেজ, সান্তনু আর তাসমিয়া। আমার ঘর ছিল কানায় কানায় ভরা।
দুপুরের আগেই ওদের গাড়ী এসে দাঁড়ালো আমার ড্রাইভওয়ে তে। হৈ হৈ করতে করতে নেমে এলো ওরা। সবাই ভিতরে আসতেই পরিচয় করিয়ে দিলাম জীবু বিয়েন আর সাথে।
কথা বলছে শেলি, ফাতেমা আর সেলিমা । আমিন আর ইউসুফ কথার ফাকে ফাকে বাহিরে যেয়ে ধূমপান করে আসছে।
গল্প কথায় ওদের সাথে মিশে যেতে যেতে মনে পড়ে গেল ৪৭ বছর আগের কথা। মেয়েদের সাথে তখন ছিল আমাদের একটা দুরের সম্পর্ক।
সম্পর্ক। কিন্তু একবার কলকাতায় এক্সকারসনে গিয়ে হয়ে গেল ওরা হোল আমাদের অনেক কাছের বন্ধু। সেই বন্ধুত্বই অটুট রয়েছে এতদিনও।
বাহিরে আবহাওয়া টা একটু মিনমিনে। রোদের আভাস কম। বাতাস বইছে। নতুন বছরের প্রথম দিনে ঠাণ্ডার প্রকোপ টা ততোটা না হলেও, গায়ে গরম কাপড় ছাড়া বের হওয়া যায় না।
আমার মেয়ে জামাই, সুষমা, রেজ এলো এলো ভড় দুপুরে লাঞ্চ নিয়ে। অনেক কিছু নিয়ে এসেছে মেয়েটা। সবাই মিলে সাজিয়ে নিলো খাবার টেবিল। মনে হচ্ছে এ বাসা আমার একার নয়। এ বাসা সবার। সেলীমা, শেলি, ফাতেমা ওরা নিজেরাই সব কিছু খুঁজে বের করে নিচ্ছে নিজের প্রয়োজন মত। বিয়ান জানে বাসার কোথায় কোণটা থাকে। দরকার মত সব কিছুর তত্ত্বাবধান উনিই করছেন।
এক সময় সাইদ ভাই বললও, “ চলো, খাওয়ার পর কল্পনার কবর টা যিয়ারত করে আসি। আজ শুক্রবার। ভালো দিন।” সবাই সমর্থন তার কথায়।
খাওয়া শেষে বেড়িয়ে পড়লাম কবরস্তানের উদ্দেশ্যে। লাল গোলাপ কিনে নিলাম। এক গাড়ীতে সবাই। শেলি বলল, “ দেখো, অদ্দ্রীষ্টের কি পরিহাস, কল্পনা নেই, আমরা যাচ্ছি তার কবর যিয়ারত করতে।”
গাড়ী এসে থামল। নেমে এলাম সবাই। লাল গোলাপ ওর খুব পছন্দ ছিল। রেখে দিলাম ওর কবরের পাশে। আমিন দোয়া করলো। সবার চেহারার মধ্যে মলিনতা। অনেকক্ষণ কারো মুখে কোন কথা নেই। কনকনে বাতাস বইছে। এবার ফেরার পালা।
ঘরে ঢুকে দেখলাম সুষমা সুন্দর করে টেবিল সাজিয়ে রেখেছে বিকালের নাস্তার জন্য। কফিটা দরকার । না এবার হবে চা র প্রস্তুতি। বললাম, আমি ভালো মসলা চা বানাতে পারি। বিয়ান সমর্থন দিলো।
অনেক দিন পর আবার প্রান খুলে হাসলাম ওদের সাথে। ফাতেমা আনন্দে আত্মহারা, স্লাম্বার পার্টি হবে আজ। কারো মাঝে আজ নৈরাশ নেই। আছে উদ্দাম উচ্ছল আনন্দ। এই ভাবে যদি জীবনটা চলে যেতো। কিন্তু তা তো হবার নয়।
রাতের খাবার বিয়ান আর সুষমা মিলে সুন্দর করে সাজিয়ে দিল। খাওয়া শেষে বিয়ানের যাবার পালা। খাওয়া শেষে বিদায় নিয়ে তিনি গাড়ীতে স্টার্ট দিলেন।
রাত গভীর। ঘড়ির কাটায় ২ টা। আমাদের আড্ডা চলছে। টিভি’র পর্দায় মুভি চলছে একটার পর একটা। অবশেষে সময় হোল আসর ভাঙার। এলিয়ে দিতে হবে সারা দিনের পরিশ্রান্ত দেহটাকে বিছানায়। জানি ঘুম আমার আসবে না। ওরা বেছে নিয়েছে যার যার ঘর। আলো নিভিয়ে দিলাম।
সকালে উঠে নিচে নামতেই দেখলাম আমিন বসে আছে। কফি আমাদের দুজনেরই প্রিয়। ফোন টা বেজে উঠল। এই সাতসকালে বিয়ানের কণ্ঠস্বর।
তিনি এসে নাস্তা বানাতে চান। বলেছিলাম প্রয়োজন হবেনা ।
কিন্তু যথা সময়ে তিনি এসে হাজির। মুখে হাসি। কোন কিছুতে তার না নেই। অনেক করেছিলেন চির বিদায় নেয়া আমার আনন্দ , আমার চল্লিশ বছরের জীবনসাথী কল্পনার জন্য। আজও করে চলেছেন ।
সব পর্ব শেষ। এবার সবাই মিলে জাক্সন হাইটসে যাবো। সাইদ ভাই এর পকেট ভেঙ্গে আমরা লাঞ্চ করবো। বিয়ান যেতে চাইলন না। তাকে যেতে হবে অন্য খানে।
জাক্সন হাইটসের রেস্টুরেন্টে ঢুকেই শেলির মনে হোল সে ভীষণ ক্ষুধার্ত। একের পর এক সে আনতে বলছে নানান খাবার। বললাম, ধীরে শেলি, ধীরে। খাওয়া শেষে উঠে পড়লাম। ওদের যেতে হবে দূর পাল্লায়। শেষ হয়ে এলো আনন্দ ভরা ৩০ টা ঘণ্টা। কোণ দিক দিয়ে কাটল এতোটা সময়। মনে হচ্ছিল, সময় টা কেন আরও দীর্ঘ হোল না। তাহলে তো আরও কিছুক্ষণ আনন্দ ফুর্তিতে কাটানো যেতো। আরও কিছু সময় মুক্ত থাকা যেতো বিষাদ থেকে। কিন্তু সময় তো থেমে থাকেনা। ঘড়ির কাঁটাকে তো থামানো যায়না। কাল তো বয়ে চলে নিরবধি। আমার কি ক্ষমতা তা বেঁধে রাখি। ?
বন্ধুদের বিদায় নেয়ার সময় এলো। আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে ওরা চলে গেল। আমি আবার ফিরে এলাম আমার সেই পরিচিত বলয়ে। সেই বলয়ে যেখানে কেটে যাচ্ছে বিষণ্ণতায় ভরা আমার একাকী দিনগুলি। ফিরে এলাম হঠাৎ একদিনের কল-কাকলীতে মুখর হয়ে ওঠা আমার সেই নীস্তব্দ বাড়ীতে। আমি ফিরে এলাম আমার নিজের জগতে। আলো নেবানো ঘরে ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দৃস্টি মেলে দিলাম সামনে। কি দেখতে চাই দুচোখ মেলে? দৃস্টি আমার কাকে খুঁজে ফেরে অতল আঁধারে? নেই কেউ নেই। নেই, কারো হাসির শব্দ নেই। কারো উচ্ছলতায় বাড়ী টা আজ আর ভরে থাকেনা। যে ছিল, আনন্দ হাসিতে যে বাড়িটা ভরিয়ে রাখত, সে আজ চির নিদ্রায় শায়িত ওয়াশিংটন মেমোরিয়ালের গভীর শীতলতায়। এখন আমার চারিদিক জুড়ে শুধু অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারে আমাকে আস্টেপৃস্টে জড়িয়ে রয়েছে আমার এই সময়ের একান্ত সঙ্গী বিষাদ।