সেই দেখা
রাতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল সনির। কামাল আর মৌসুমি ডেকে ছিল তাদের বাসায়। ঘরোয়া পরিবেশে গান বাজনা হবে। দেশ থেকে আসা এক শিল্পীর একক অনুষ্ঠান।
বিশাল বাড়ী কামালের। ইন্ডাস্ট্রির মালিক। পয়সা কড়ির অভাব নেই। দেদার খরচ করে। মুক্ত হস্তে দানও করে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান।
একদিন সনি জিজ্ঞাসা করেছিল, এই যে তুই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান সময় পাশ কোথায় কাজ করার। তোকে তো তোর ইন্ডাস্ট্রিও দেখতে হয়।
হেসে বলেছিল, আমি নিজেই জানি না আমি কোন সংঘটনের চেয়ারম্যান আর কোনটার ট্রাষ্টি বোর্ডে আমার নাম রয়েছে।
ওরা এসে বলে, কামাল ভাই শুধু আপনার নামটা আমরা চাই। ওটা থাকলে অন্যান্যরা এসে যোগ দেবে আমাদের সংঘটনে।
আমার ক্ষতি কি? নামটা প্রচার হোল।
সনি আর কথা বাড়ায় নি।
বেশ কিছু বন্ধু বান্ধব, সেই সাথে নাম না জানা কয়েক জনের সাথে গল্প করতে খারাপ লাগেনি।
গান শেষ হতে হতে রাত প্রায় একটা।
ঘুম টা এসেছিল সনির ভোর হওয়ার কিছু আগে। ভেঙ্গে গেলো সারেগামার শব্দে। ছোট্ট দুটো ছেলেমেয়ে গলা সাধছে।
বয়স চার পাঁচ। একই বাসার উপরে সনি থাকে আর নিচে ওরা চার জন।
মেয়েটা সাঁ বলে টান দিতে দিতে ছেলে টা রে ধরেছে।
রাগ হলনা সনির । বরং ভালই লাগছিল ওদের গলা সাধা শুনতে।
সপ্তাহর শুরুতে ওরা রপ্ত করে রাতের বেলা।
আজ স্কুল বন্ধ। তাই সকালে সাধছে গলা।
মাঝে মাঝে ওর মা বসে পূজাতে। টুং টুং ঘণ্টীর শব্দ। পুজা অর্চনা চলে।
সামন্ত এসেছিল সেদিন। শুধু বলতে, বাচ্চাদের কলাহলে সনির কোন অসুবিধা হয় কি না।
“অসুবিধা? কি যে বলও, আমি উপভোগ করি, বরং যেদিন কোন সাড়াশব্দ পাইনা সেদিন মনে হয় বাসাটা ঝিমিয়ে গেছে” বলে ছিল সনি।
সামন্ত শুধু হেসেছিল।
সামন্ত সনির অনেক ছোট। এসেছে ভারতের কেরালা থেকে। দুই বছরের কন্ট্রাক্ট।
মুখে হাসি, বলেছিল সনি কে, তোমার কোন দরকার পড়লে আমাকে জানিও।
তার ত্রুটি সে করেনি।
হঠাৎ একদিন সনির ৬০ ইঞ্চি টিভি টা অন্ধকারে ডূবে গেলো।
কথা শুনা যাচ্ছে কিন্তু ছবি নেই।
মেজাজ টা খিচিয়ে উঠল সনির।
Netflexএ প্রিয় শো Narcos দেখছিল।
হঠাৎ ই নিচে সামন্তর গলার স্বর শুনতে পেলো সনি। কাজ থেকে ফিরেছে সামন্ত।
মনে পড়ল সনির, ও বলেছিল দরকার পড়লে ডাক দিতে।
দোটানায় পড়ল সে । এই মুহূর্তে ওকে ডাকা সমীচীন কি না।
কথায় বলে, মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি। তাই হোল।
সামন্তর কল। সে উপরে আসতে পারে কিনা জানতে চাইছে। বাড়ীভাড়া টা সনির কাছে দিয়ে যাবে। সে যেন বাড়ীর মালিকের কাছে পৌছে দেয়।
“নিশ্চই। সময় মতো এসো। তাড়াহুড়ার দরকার নেই। আমি বাসাতেই আছি”। বলেছিল সনি।
যাক আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে হোল না বলে একটু স্বস্তি পেলো সনি।
না, সে দেরী করেনি। এসে হাজির।
টাকাটা গুনে নিয়ে বলল সে , তুমি কি ব্যাস্ত?
না, কেন?
টিভি টার ব্যারামের কথা বলতেই লেগে গেলো সমস্যার সমাধান করতে। সনির কাছে যন্ত্রপাতি বিশেষ কিছু নেই।
সে নিয়ে এলো তার টুলবক্স। ইউটিউবে দেখে নিলো কি কি সমস্যা হতে পারে।
পরিশেষে জানা গেলো ভিতরের টিউব টা নষ্ট হয়ে গেছে।
অগত্যা সনির শোবার ঘরে যে বড় টিভি টা আছে, ওটা কে আনতে হবে এখানে। প্রচণ্ড ভারী।
সনি বলেছিল সে কোন রকম সাহায্য করতে পারে কিনা।
বলল, পাগল, তোমার কিচ্ছু করতে হবে না। আমিই সব করব।
সনি চেয়ে চেয়ে দেখল, সে এ ঘরের টা ও ঘরে, ও ঘরের টা এ ঘরে এনে টিভি টা অন করল ।
আলো জ্বলে উঠলো টিভি তে।
সনি কি বলবে বুঝে উঠতে না পেরে শুধু বলল, “কি করে এই ঋণ শোধ করবো বলতো”।
বলল, শুধু খেয়াল রেখো আমার ছেলে মেয়ে দের কে। মাঝে মধ্যে ওরা সাইকেল নিয়ে ছোটা ছুটি করে।
ভয় হয়।
আমি থাকি কাজে। ওর মা ও ব্যাস্ত থাকে অনেক সময়।
অবশ্যই। কোন চিন্তা করোনা। আমি তো আছি। বলে সনি ওর হাতটা বাড়িয়ে দিলো সামন্তর দিকে।
বাহিরে ঝড় বৃষ্টি। আকাশ কালো মেঘে আচ্ছন্ন। ছোট ছোট ঘটনা সনির মনে পড়ল।
এই তো সেদিন, ষ্টেশনে দাড়িয়ে অপেক্ষা করছিল ট্রেনের।
সনি না?
পাশ ফিরে তাকালও সনি। শাড়ী পরনে। চোখে চিকন কালো ফ্রেমের চশমা। আধা পাকা চুল। হাতে মাইকেল কোরের ব্যাগ।
চিনতে পারলো না সনি।
মনে পড়ে গায়ত্রীর কথা? সেই সত্তর শনে, কলকাতার যাদবপুরে। বলে তাকিয়ে রইল সনির দিকে।
হাঁ, মনে পড়েছিল সনির।
ইউনিভার্সিটি থেকে গিয়েছিল ওরা কয়েকজন কলকাতায়। এক্সকারসনে। যাদবপুর ইউনিভার্সিটির হলে ওদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল।
দেখা হয়েছিল গায়ত্রীর সাথে। হঠাৎ ই।
রাতে সিনেমা দেখে সনি আর কামাল ভুল রেলওয়ে ষ্টেশনে নেমে ছিল। রাত তখন দশটা। বুঝে উঠতে পারছিল না কি করবে। পকেটে টাকার পরিমাণ খুবিই কম। ট্যাক্সি নিতে পারবে না।
নতুন জায়গা। বন্ধুরা না করেছিল। ওরা শোনেনি। দিলীপ কুমারের নতুন মুভি। দাস্তান।
ভয় পেয়ে ছিল ওরা। ঠিক সেই সময়, “ হারিয়ে গেছেন বুঝি। কোথায় থাকেন?”
ওরা জাগার নাম বলতেই মেয়ে টা বলল, আমিও ঐখানে যাচ্ছি। আসুন, এখনি ট্রেন আসবে।
আমার নাম গায়ত্রী। আমিও যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে পড়ি। তবে থাকি বাসাতে।
সনির একটা গুন সবাই জানে। অতি সচ্ছল ভাবে সে কথা বলতে পারে সবার সাথে। মনে হবে অনেক দিন ধরে সে চেনে।
এখানেও ব্যতিক্রম হোল না।
ওদের কথা শেষ হোল তখন, যখন উভয়ে এসে পৌছাল নিদৃষ্ট ষ্টেশনে।
আমি যাবো আপনাদের উল্টো পথে। আপনারা সোজা চলে যান, সামনের ঐ লাইটে ডানে মোড় নিলে আপনাদের হোস্টেল। বলে হাসল।
আর দেখা হবে কি? কেন বলেছিল সনি জানেনা।
হবে বৈকি? এক জাগায় যখন থাকি। আর আপনি হচ্ছেন আমাদের গেস্ট। আমিই আসবো দেখা করতে।
গায়ত্রী এসেছিল। দেখা হয়েছিল। ওরা বসে অনেক কথা বলেছিল হলের ক্যান্টিনে। আপনি থেকে তুমি সম্বোধন। কত যে কথা যার কোন মানে ছিল না।
যাওয়ার দিন গায়ত্রী একটা রুমাল দিয়েছিল সনি কে। কোনায় এমব্র্যডারি করে একটা অক্ষর শুধু লেখা ছিল “গ”।
না আর দেখা হয়নি। ডিপার্টমেন্টে দুই টো চিঠি এসেছিল গায়ত্রীর।
উত্তর দেওয়া হয়নি সনির।
কি চিনতে পারলে না?
পেরেছি, অনেকদিন পরে তো।
তুমি একদম পাল্টাওনি। ঠিক সেই রকম আছো।
কোথায় থাকো? জিজ্ঞাসা করলো সনি।
এখান থেকে দুই ষ্টেশন পরে। এই আমার ঠিকানা, এই আমার সেল নাম্বার। কল দিও। অনেক কথা আছে তোমার সাথে।
সেই রুমাল টা আছে কি?
গায়ত্রীর ট্রেনটা এসে গেলো। উত্তরের অপেক্ষা না করে ও উঠে পড়লো ট্রেনে। জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইল সানি যেখানে দাড়িয়ে সেই দিকে।
বাহিরে বৃষ্টি টা কমে এসেছে। সনি উঠে দাঁড়াল। এসে দাঁড়াল টেবিলের কাছে। ড্রয়ার টা খুলল।
3 Comments
ছোট ছোট ঘটনা কিন্তু বাস্তবতায় ছাঁওয়া।শেষটা পড়ে মনে হলো হয়তোবা ড্রয়ারে কি আছে তা পরবর্তীতে জানা যাবে কিংবা কৌতুহল জাগিয়ে এখানেই শেষ।ভালো লেগেছে!!!
Is it real story? It seems like that.l like it.
ভালো লাগলো।