টেগোর

 

নাতি আমার দেড় বছর হবে আর কিছুদিন পর। সেই একদিন বয়সের টেগোর আর আজকের টেগোরের মাঝে পরিবর্তন আমি লক্ষ করছি।
ও হাঁ, টেগোর শুনে অনেকে মনে করবে এ কোন টেগোর।
না, আমি আমার নাতির কথাই বলছি।
এই নাম কোথা থেকে এলো?
ওর বাবা, মা, অর্থাৎ আমার ছেলে আর বৌমা একদিন এক রেস্টুরেন্টে খেতে বসে বলল, জানো আব্বু আমরা আমাদের মাঝে আসছে নতুন অতিথির কি নাম হবে তা ঠিক করেছি।
তাই?
অনুমান করো, কি নাম হবে?
অনেক নামই বললাম, আমি, সুষমা আর জীবন(হবু নাতির নানী) ।
না হোল না। বলে তাকালও সে তাসমিয়ার দিকে।
বলব, তবে কাউকে বলবে না। ঠিক আছে? করাল কাটিয়ে নিলো আমাদের কাছ থেকে।

ওর নাম হবে টেগোর কামরুল আলম।
আকাশ থেকে পড়লাম আমি। না শুধু আমিই নই , সবাই।
টেগোর? তুমি কি জানো টেগোর কে?

কেনও জানবো না? স্টাডি করেছি টেগোরের উপর। আর তোমার গাড়ীতে চলতে চলতে তো শুধু টেগোরের গানই শুনতাম।
বলল সে।
এদেশে জন্মে, ভাঙ্গা বাংলায় কথা বলে, ওরা যে টেগোর কে ওদের ঘরে নিয়ে এসেছে,এঁর চেয়ে বড় আর কি হতে পারে।
বললাম, আমি মুগ্ধ। আমি হয়তো থাকবো না ও যখন বড় হবে, তোমরা ওকে শিখিও, জানতে দিও টেগোর কে। তবেই হবে ওর নামের সার্থকতা।

তারপর বেশ কিছুদিন গড়িয়ে গেছে।
হঠাৎ একদিন তাসমিয়া, শান্তনু ডাক দিলো আমাকে। বলল, চলে এসো আমাদের বাসায়। দেখবে টেগোরের ঘরটা কি ভাবে সাজিয়েছি।
তখনো সেই ছোট্ট তুলতুলে টা এসে পৌছায় নি।

আমি এলাম। দেখলাম ঘরটা। ছোট্ট শোয়ার বিছানা। পাশে Reclining chair. দুধ খাওয়ার সময় দোল খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়বে ছোট্ট মনি।
দালানের রঙ অফ হোয়াইট। তার মাঝে বড় বড় করে করে রবীন্দ্রনাথের অনন্ত প্রেমের কোটেশন
“তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শত রূপে শতবার
জনমে জনমে যুগে অনিবার”।
অপূর্ব।
পছন্দ হয়েছে? দুজনে একি সাথে বলে উঠল।
খুউব-।

সেই তুলতুলে টা একদিন ঝড়, বাদল, বরফ মাথায় নিয়ে এসে হাজির হোল। জানালো তার আগমন বার্তা।
আমি এসে কোলে নিয়ে দুধ খাওয়াই। ডাইপার পালটিয়ে দেই।
চোখ মেলে চাইতো না সে।
শান্তনু জিজ্ঞাসা করেছিল, আব্বু পারবে এসব করতে?
হেসে বলেছিলাম, তোমাদের দুই ভাই বোনকে তো করেছিলাম, সেই রাতে উঠে দুধ খাওয়ানো, ডাইপার পালটানো।
তখন করতে পারলে, আজ ও পারবো।

দিনে দিনে দিনগুলো পাড় হয়ে গেলো।
মায়া বাড়তে থাকলো।
দরজা খুলে আমাকে দেখলে ফিক করে হেসে দিতো। দুই হাত বাড়িয়ে দিলে ঝাঁপিয়ে পড়তো।
তখনো সে হামাগুড়ি দিতে শিখেনি।
লোকে বলে আসলের চেয়ে ফাউ এঁর উপর মায়া বেশি।
ওর দাদি বলতো, নাতি, নাতনী যাই হোক, আমি ওদের কে স্পয়েল করে দেবো। সে সুযোগ সে আর পেলো না। তাই মাঝে মাঝে ওর দাদির ছবি দেখিয়ে বলি, চিনতে পারো, কে এই সুন্দরী?

একদিন সন্ধ্যায় বসে চা পান করছি। শান্তনু বলল, আজ টেগোরের sleep traning হবে।
sleep traning মানে?
তখনও টেগোরের বর্ষ পূর্তি হওনি
ঠিক সাত টায় ওকে গোসল দিয়ে খাওয়া দাওয়া করিয়ে, পাশে বসে বুক রিডিং করে, শুইয়ে দেবো।
তারপর?
ও আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়বে।
যদি না ঘুমিয়ে কাঁদে।
কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়বে।
ঠিক আছে।
বেশিক্ষণ আমি বসতে পারিনি। কান্নার আওয়াজ আমার কানে আঘাত হানল। বললাম, আমি চললাম, এই কান্না আমি সহ্য করতে পারবো না।
আব্বু, আস্তে আস্তে সয়ে যাবে তোমার।
জানিনে বাবা, আমরা সেকেলে হয়ে গেছি। তোমাদের নতুন পদ্ধতি আমার পোষাবে না। আমি চললাম।
সারাটা পথ আমার কানে ওর কান্নার স্বর বাজছিল। ও আমাকে এতো মায়ায় কেন জড়িয়ে ছিল, জানিনা।

দুদিন পর এলাম, আমাকে দেখে ওর নানীর কোল থেকে আমার কোলে এলো। জীজ্জাসা করলাম, রাতের কি অবস্থা?
ওর নানী বলল, এই দুদিন কাঁদেনি।
ওর নানী বাসা বাড়ী, কাজ, সবকিছু ছেড়ে দিয়ে নাতি পালতে এসেছে। ঝড় তার উপর দিয়েই যায় বেশি।
আমি আসি। ওর নানী কিছুটা সময় পায় তার নিজের কাজ ঘুছাতে।
সেই সাথে মায়া বাড়ে।
প্রতিদিন না আসতে পারলেও Taggy Fan Club এর মাধ্যমে দেখতে পাই টেগোরকে। ওর নানী সকাল সন্ধ্যায় ওর বিভিন্ন ধরণের দুষ্টুমি গুলো তুলে ধরে। আমি দেখি, সবাই কে দেখাই। মাঝে মাঝে শেয়ার করি দুরে যারা আছে। এ যেন আমার নতুন চাকরি।
এখন সে হাটতে শিখেছে। একটা কথা স্পষ্ট করে বলে, বাইরে।
মানে ওকে বাইরে নিয়ে যেতে হবে।
ঠ্যাঁটামি বেড়েছে।
ওর ইচ্ছে মত আমাকে দাড়িয়ে থাকতে হবে অথবা বসতে হবে। না করলে চলবে না। মাথা খুঁটবে। ফেক কান্না কানবে।
নাতি আমার চালাক কম নয়।
এই তোঁ সেদিন ওর মা নিয়ে গেছে পার্কে। বাসার পাশেই পার্ক। ওখানে তার নিত্যদিনের যাওয়া আসা।
দোলনায় দুলে দুলে হাত দিয়ে দেখালও এবার সে পানির ফোয়ারাতে খেলবে। খেলছে সে, ঠিক সেই মুহূর্তে ছোট্ট একটা ওরই বয়সের তুরবুরানী মেয়ে পানিতে ভিজতে ভিজতে এসে ওর গালে চুমু দিয়ে দিলো।
এই বয়সে? আমি হাঁ হাঁ করে হেসে উঠলাম।

মাঝে মাঝে সকাল সন্ধ্যা কাটিয়ে দেই ওর সাথে। বলি কি, বড় দেড়ি করে এলি, এখন আমার মাজায় ব্যাথা, বয়স হয়েছে, তোর সাথে পাল্লা দিয়ে কি আমি পারি।
মায়ায় ভরা হাত দুটো মেলে দেয়, কোলে উঠবে। কোলে উঠে মাথা টা গুজে দেয় আমার কাঁধে।
ঘুমাবে না, আদর নেবে।
সন্ধ্যা হয়ে আসে। আমার চলে যাবার পালা।
কত বার শান্তনু তাসমিয়া বলেছে, থেকে যাও আব্বু, তোমার জন্য নিচে থাকার সব ব্যবস্থা করে দিয়েছি।
মাঝে মাঝে থাকি। কিসের টানে যেন চলে যেতে হয়।
যাবার সময় চুমো দি য়ে বলি, আসি সোনা।
ওর চোখের দৃষ্টি দেখে বুঝতে পারি ও যেতে দিতে চায় না। ছলছল চোখ।
ফিরে আসি দরজার থেকে।
ঝাঁপিয়ে পড়ে কোলে। কিছুক্ষণ থাকি আরও।
ওর নানীর কোলে দিয়ে বলি এবার যেতে হবে।
ওকে নিয়ে ওর নানী চলে যায় অন্য দিকে।
আমি দরজা খুলে বেড়িয়ে পড়ি। ভাসতে থাকে আমার চোখে ওর জলে ভরা চোখ দুটো।

You may also like

3 Comments

  1. এক কথায় অপূর্ব হয়েছে লেখাটা !!!
    খুব খুব ভালো লেগেছে।কথায় বলে না ভালোবাসা নিম্নগামী।টেগোরের আঙ্গুল উচিয়ে “ বাইরে “বলার ভঙ্গিমাটা এতো মধুর আমি এখনো ভুলতে পারছি না।

  2. Khub valo legese.Tagore shudhu apnar na amar valo thakar ar valo lagar akjon. Oke dekhle mon valo hoie jai ato mayai jorano upsos apa dekte parlona.o valo thakuk amader monta aro vorie dik ai dua kori.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *