চারিদিকে অসুখ আর মৃত্যুর খবর। খবরের কাগজে আছে খুন খারাবি আর ধর্ষণের। টিভি তে আছে পলিটিক্সের মারপ্যাঁচ।
এই সব দেখে ধুত্তর, বলে টিভি টা বন্ধ করে দিল আমজাদ। বলতে গেলে সারাদিন আজ সে বাসাতে বন্দি। বাহিরে একবার বেড়িয়ে ছিল কিছুক্ষণের জন্য, চা এর দুধ টা ফুরিয়ে গেছে, ওটা আনতে।
বাবুল কে ফোন দিল। এই একটা স্বভাব তার। সাথে সাথে ফোন ধরবে না। বললে বলবে, ফোন টা পড়েছিল বেডরুমে। অথবা সে ছিল বাথরুমে। ঠোটের কাছে কথা এসে থাকে। সেটা আমজাদ জানে। তবু ও কল করে তাকে। একমাত্র সেই অন্যদের মতো নয়।
অন্যদের সাথে কথা বললে মনে হবে ওরা কবে গোড়ে অর্থাৎ মাটির নিচে যাবে সেই চিন্তায় মগ্ন। ওদের ধ্যান ধারনা ইহকালের নয়, সব পরকালের। ফলে কথা বেশিক্ষণ চলে না।
আর একবার কল করতেই, ফোন টা উঠাল বাবুল।
কি ব্যাপার আমজাদ ভাই। কি করেন?
বসে বসে ভ্যারেণ্ডা ভাজছি।
চলে আসেন। ডিনার করবো একসাথে।
এইজন্য বাবুলের সাথে মেলে ভাল। আড্ডা মারতে জানে। আমজাদ ও মনে মনে তাই চাইছিল। ঘরে আজ খাবার বাড়ন্ত না হলেও, ওই একই খাবার খেতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া মন টাও বিগড়িয়ে আছে।
কিছুক্ষণ আগে কাকলি কল করে বলেছিল, সে যেতে পারবে না আমজাদের সাথে অনুষ্ঠান দেখতে।
পাঁচ ছয় জন বন্ধু বান্ধবী মিলে যাওয়ার কথা।
কাকলিই আমজাদকে একদিন বলেছিল, আমজাদ ভাই কোন দিন যদি কোন প্রোগ্রাম করেন তাহলে আমাকে জানাবেন। আমি যেতে চাই। মোহিত তো এই সবে ইন্টারেস্টেড না।
সেই জন্যই আমজাদ ওকে জানিয়েছিল, নামকরা কিছু আর্টিস্ট আসছে, ভাল অনুষ্ঠান হবে, যাবেন?
রাজি হয়েছিল, টিকিট ও কাঁটা হয়েছে।
এখন বলে সে যেতে পারবেনা কারন মোহিতের সম্মতি নেই।
আমজাদের বুঝতে বাকি নেই, কারন টা যে তারই জন্য। সেইজন্যও মেজাজ টা খিঁচিয়ে আছে।
সাড়ে সাতটার দিকে আসবো। খাওয়ায় কম পড়বে না তো?
আপনি যে পরিমাণ খান, তাতে কম হবে না বরং কিছু বেচে যেতে পারে। বেঁধে দেবো? বলে হাসতে থাকলো বাবুল।
ওপাশ থেকে সাথী অর্থাৎ বাবুলের বৌ এর গলা শুনতে পেলো আমজাদ।
জিজ্ঞাসা করতে বললও, আমজাদ ভাই পাতলা না ঘন ডাল খাবে।
যে কোন একটা হলেই চলবে, ফকিরের আবার চয়েস। বললও আমজাদ।
সন্ধ্যা টা ভালই কেটে গিয়েছিল আমজাদের। বেঁধে দিয়ে ছিল সাথী ভাবী।
অনেক বার না করেছিল আমজাদ, বলেছিল, সামনের সপ্তাহ থেকে একজন কে পেয়েছি, সে পাঁচ দিনের খাবার সাপ্লাই দেবে। এতদিন পড়ে একটা সুরাহা হোল। কি বলেন, ভাবী।
কেন আমাদের কাছ থেকে খাবার নিতে আপনার বাধে।
না না তা কেন। আপনাদের উপর ভরসা করেই তো এতদিন চলেছি। ডিমান্ড এর চেয়ে সাপ্লাই ছিল প্রচুর। বলে হাসতে থাকলো আমজাদ।
সন্ধ্যাটা ভালই কেটে গেলো। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখল নয়টা বাজতে তখনো পাঁচ মিনিট বাকি। এশার নামাজ টা ধরতে পারবে। গাড়ীতে উঠে আমজাদ ভাবল সে তো একসময় এপথের পথিক ছিল না। পরিস্থিতি তাকে এই পথে এনেছে।
না, সে গোঁড়ামি পছন্দ করে না। যার জন্য অনেকের বিরাগভাজন। কথা কাটাকাটিতে সে যেতে চায় না।
যে এই পথে এনেছিল সে তো পাড়ি জমালও।
যাওয়ার সময় আমজাদ কে বলেছিল, আমি তো চললাম, তুমি আমার হয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে আমার জন্য দোয়া করো।
আমজাদ কথার খেলাপ করেনি।
মসজিদে এসে দেখল খুব একটা লোকজন তখনো আসেনি। ইমাম সাহেব তার রুমে বসে কি যেন লিখছে।
বিরক্ত করতে চাইলো না আমজাদ।
ইমাম সাহেবই ডাক দিলো।
কি কারনে যেন ইমাম সাহেবের সাথে একটা অদৃশ বন্ধন সৃষ্টি হয়েছে। আমজাদ আজও বুজতে পারেনি কেন হোল, কি ভাবে হোল।
এই তো কিছুদিন আগের কথা, ইমাম সাহেব আমজাদ কে দাওয়াত করেছিল উনার বাড়ীতে। প্রথমে আমজাদ বুজতে পারেনি ইমাম সাহেব কি বলতে চাইছে।
জিজ্ঞাসা করেছিল, কি বলছেন?
আমার বাসায় আপনার দাওয়াত।
কথাটা আমজাদ রিপিট করে বলেছিল, আপনার বাসায় আমার দাওয়াত?
হা। আমিতো সহজ বাংলাতে বলছি। ইমাম সাহেবের মুখে হাসির আভা। আসবেন তো?
অবশ্যই। ইমামের বাসায় দাওয়াত কস্মিনকালেও শুনিনি তো, তাই একটু দেরী হোল বুজতে। বলে হাসতে থাকলো আমজাদ।
আমজাদ গিয়েছিল। বসে বসে শুনছিল উনার চার ভাই আর অন্যান্য দের আলোচনা। কাটখোটটা আলোচনা নয়। বর্তমান পরিস্থিতি, সেই সাথে হাদিস নিয়ে আলোচনা।
ইমাম সাহেবেরা চার ভাই। চার ভাই ই হাফেজ। শুধু তাই নয় বড় বড় ইউনিভারসিটি থেকে পাশ। গোঁড়ামি নাই।
সেইজন্যই হয়তো আমজাদের সাথে মেলে ভাল।
কি ব্যাপার চেহারায় মলিনতা কেন? শরীর ভালত? নতুন জোক শুনাবো?
আপনার জোক শুনলে তো আমাকে আবার অজু করতে হবে।
দুজনই হো হো করে হেসে উঠলো।
ইমাম সাহেব, একটা কথা বলব? আমজাদ প্রশ্ন করে তাকাল।
নির্বিঘ্নে।
ছোট বেলায় কোরান শরিফ পড়ার চেস্টা করেছিলাম, হয়ে উঠেনি। একটু যদি সময় করে দেখিয়ে দিতেন।
অবশ্যই। ফজরের পরে আপনাকে নিয়ে বসব। ঠিক আছে।
আমতা আমতা করে আমজাদ বলেছিল, মানে কত দিতে —-
কথা শেষ হতে দেইনি ইমাম সাহেব, বলেছিল, ওই কথা যদি বলেন, তবে আপনার আসার দরকার নেই।
বাসায় ফিরে আসতেই ফোন এলো ছোট বোনের কাছ থেকে।
ছোটদা, জাহাঙ্গীর ভাইএর শরীর টা ভাল না। আবার হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে। তুমি কি একটু কল করবে ঊর্মিকে।
আমজাদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল সকাল হয়েছে বাংলাদেশে।
ঊর্মি ফোন ধরেই বললও, বাবার হার্ট অ্যাটাক মত হয়েছে। আই সি উ তে আছে। এযাত্রা কি হয় বলতে পারছি না।
আমজাদের এই বোনটার উপর দিয়ে অনেক ঝড় ঝাপটা গেছে। প্রথম স্বামী কে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় রাজাকাররা উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল বাসা থেকে। আর ফিরে আসেনি। ঊর্মি তখন পেটে। ও বাবা কে দেখতে পায়নি।
অনেক কষ্ট করে দুই ছেলে মেয়ে কে মানুষ করেছিল সে।
দেখা হয়েছিল জাহাঙ্গীরের সাথে। সুখের সংসার। কিন্তু তা আর ওর কপালে সইল না। জাহাঙ্গীরের ব্লাডে ক্যান্সার ধরা পড়ল। বাসা হাসপাতাল নিয়েই ব্যাস্ত সে। আমজাদ মাঝে মাঝে ফোন করে। কি বলবে সে? সান্ত্বনা দিয়ে লাভ কি?
শুয়ে শুয়ে আমজাদ ভাবছিল, সুখের দিনগুলো বড় তাড়াতাড়ি চলে গেল। সামনে শুধু এবড়ো থেবড়ো পথ। আলো টা নিভিয়ে দিলো। অন্ধকারে ঢেকে গেলো ঘর টা।
চি চি আওয়াজ করে ফোন টা বাজছিল। সকালের দিকেই ঘুমটা আসে আমজাদের। প্রথমে ঘুমের ঘোরে বুজতে পারানি কোথা থেকে আওয়াজ টা আসছে। বুজতে পেরে ফোনটা উঠিয়ে দেখল নয়টা বেজে গেছে। সেলিমা কল করেছে।
কি ঘুম ভাঙালাম?
অনেক টা তাই।
শোন, কে কি নিয়ে যাবে ঠিক করেছি। তুমি শুধু Disposible কাপ প্লেট আর কফির সরঞ্জাম আনবে। ঠিক আছে?
দুই দিনের জন্য পাঁচ বন্ধু বান্ধবী সাথে রোড আইল্যইন্ডে যাওয়ার কোথা। আমজাদ সব ব্যবস্থা করেছে। Airbnb পাওয়া গেছে। নদীর পাশে।
আমজাদ, সেলী, ইউসুফ, আমিন, সেলিমা, ফাতিমা। ঢাকা তে ইউনিভারসিটি পড়া কালিন এই ছয় জন একসাথে ঘোরাঘুরি করত। সেলিমার ছিল ফীয়াট গাড়ী। ওই ছোট্ট গাড়ীর ভিতর ছয়জন কি ভাবে আঁটত আমজাদ ভেবে পায় না। অবশ্য আমজাদের ওজন ছিল তখন নব্বই পাউন্ড। অন্যদের ও একই অবস্থা।
হাসি পায়। আজ একশো পঞ্চাশে দাঁড়িয়েছে।
প্রতি বছর ওরা কোথাও না কোথাও যায়। ওদের সাথে আমজাদের জমে ভাল। চুল ছেড়া ছেড়ির গল্প নেই। পলিটিক্স নিয়ে আলোচনা। তাও এখানকার পলিটিক্স। পলিটিক্স শেষে গান চলছে। রাত একটা দুটো পর্যন্ত।
আমিন, শেলী Democratic পার্টির সাথে ভীষণ ভাবে সংযুক্ত। বলতে গেলে শেলী ফিলাডেলফিয়ায় ওদের জাগার Democratic পার্টির হর্তাকর্তা বিধাতা।
দোতালা বাসা। পিছনে নদী। হৈ হট্টগোল নেই। চারিদিকে নীরব নীঝুম। পাখির কল কাকুলী। কাটবেড়ালি গুলো গাছের উপরে উঠছে নামছে। এক কথায় অপূর্ব দৃশ্য।
সকালের নাস্তা সেলিমা তৈরি করে। ফাতেমা জোগান দেয়। সবাই বসে গল্প করতে করতে খায়। প্রতিদিনের এক ঘেয়েমী থেকে বেড়িয়ে আসার মাঝে যে কি আনন্দ তা ওরা উপলব্ধি করে।
দুটো দিন আনন্দের মাঝে কেটে গেলো আমজাদের। কথা হোল এবার ওরা সবাই মিলে ইন্ডিয়া যাবে।
আমজাদকে বলল সব ব্যবস্থা করতে।
আমজাদ রাজি।
এবার ফেরার পালা। বিদায় নিয়ে আমজাদ উঠে পড়ল গাড়ীতে। ওকে একলা ফিরে যেতে হবে।
কথা হোল মাঝ পথে থামবে কোন সার্ভিস ষ্টেশনে। সেখানে হবে শেষ কফি খাওয়ার পর্ব।
তারপর গুড বাই।
3 Comments
তোমার লেখাটার ভিতরে এমন একটা সুর আছে যা মনের তারে টোকা দেয়।খুব সাবলীল লেখা।
Sohoj sabolil lekha. Porte valo lage.
Din japoner lekha tobuo keno jani porte valo lage.