ট্রেনটা এসে দাঁড়াল ষ্টেশনে। এটাই প্রীতির ষ্টেশন। নামতে হবে। প্রতিদিনের মতো আজও অনেক কষ্টে ঠেলাঠেলি করে নেমে এলো। শীতের সন্ধ্যা। আজ যেন ঠাণ্ডাটা একটু বেশি মনে হোলও প্রীতির কাছে। বাতাস বইছে। মাফলার দিয়ে গলাটা ঢেকে নিলো। কোটের হুডটা মাথার উপর উঠিয়ে দিলো।
তিন রাস্তা পাড় হয়ে তবে তার বাসা।
আগে জহীর গাড়ী নিয়ে এসে দাড়িয়ে থাকতো। গাড়ীতে উঠেই প্রীতি ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে বলত, বড্ড খিদে পেয়েছে, চল না ঐ কাছের রেস্টুরেন্টে যেয়ে বসি।
দুজনে এসে বসত সেই রেস্টুরেন্টে। চা র সাথে দুটো কাবাব, নয়তো সিঙরা। ঘণ্টা খুব তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যেতো।
জহীর ওকে বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে চলে যেতো।
সে তো আজ অনেকদিন আগের কথা।
প্রীতি পিছন ফিরে তাকাল। রেস্টুরেন্টের নিয়ন সাইন টা জ্বলজ্বল করছে। ঐখানে আর সে এসে বসে না।
ভাল আর ভালবাসার দিনগুলো যেন তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যায়। কষ্টের দিনগুলো ফুরাতে চায়না।
আজ কেনই এসব কথা মনে পড়ছে সে নিজেও বুঝতে পারছে না।
মনে পড়লো মা বলেছে, বাসায় রুটি আর দুধ নেই।
ঘুরে দাঁড়ালো প্রীতি। পাশেই সুপারমার্কেট। কনকনে বাতাসটা ঝাপটা মারলও মুখে। হাতের ব্যাগ টা কাঁধে ঝুলিয়ে নিলো।
ভিতরে এসে দাঁড়ালো প্রীতি। চশমাটা খুলে চোখটা মুছে নিলো।
প্রীতি আপা, কেমন আছেন?
চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল সামনে দাড়িয়ে বেবী। এই মুহূর্তে কারো সাথে কথা বলতে ইচছা করছিলো না। বেবীর সাথে তো নয়ই। বড় বাচাল মেয়ে।
ভালো, তুমি?
সে কথায় না যেয়ে বেবী গলার স্বর একটু নিচে নামিয়ে বলেল, শুনেছেন নিশ্চয় করিম ভাই আর ভাবীর কেচ্ছা।
করিম আর ভাবীর কেচ্ছা শোনার ইচ্ছে প্রীতির নেই, তার নিজের জীবনেই অনেক কেচ্ছা রয়েছে।
বলল, না শুনিনি। আমার একটু তাড়া আছে, আর একদিন শুনবো। বলে পাশ কাটিয়ে বেড়িয়ে এলো।
বেবী হতাস মনে দরজা খুলে বেড়িয়ে গেলো।
দুধের দামটা একটু বেশি মনে হোলও প্রীতির কাছে। কে জানে। যাদের টাকা গুনে গুনে চলতে হয় তাদের কাছে সব কিছুরই দাম বেশি মনে হয়।
আগে কখনও কোনটার কত দাম দেখিনি সে। যেটা কিনতে ইচ্ছা করতো শপিং কার্টে উঠিয়ে নিতো। মাঝে মাঝে জহীর বলতো, কি ব্যপার, বাসায় মাছ, মাংস, তরিতরকারির কোন অভাব আছে বলে তো মনে হয় না, আবারও কি নিয়ে এলে।
ও তুমি বুঝবে না।
জহীর ও কথা বাড়াতও না।
মেম। কাউন্টারের মেয়ে টা ওকে বলছে।
চমকে তাকিয়ে বলল, সরি।
আজ কি যে হোলও প্রীতির।
দামটা মিটিয়ে দিয়ে বেড়িয়ে এলো।
একটু দুরে বেশ একটা জটলা। অনেক গুলো পুলিশের গাড়ী, এম্বুল্যান্স। ঐ জটলা পেড়িয়েই প্রীতি কে যেতে হবে। এই ঠাণ্ডার মধ্যে এতো লোক কোথা থেকে এলো। ভাবতে যেয়ে হোঁচট খেলো ভাঙা ফুটপথের এক ইটের সাথে। ঠাণ্ডা তে হোঁচট খেলে ব্যাথা লাগে বেশি। পাশে একটু দাঁড়াল প্রীতি। রাস্তাটা সমতল নয়। উপরে উঠতে মাজা ধরে আসে।
জটলাটার কাছে এসে দাঁড়ালো প্রীতি। এক্সিডেন্ট হয়েছে, তাই এতো লোকজন। তাকালও না সে। অহরহ হচ্ছে।
আরও একটা ব্লক হাটতে হবে।
বাবা চলে যাওয়ার আগে বলেছিল। মা, তুই আর কত কষ্ট করবি। আমরা বোধহয় তোর বোঝা হয়ে গেলাম।
এমন কথা বলবে না বাবা, আমার মনে অনেক কষ্ট লাগে, বলে বাবার বুকে মুখ গুজে কেঁদেছিল। বাবা মেয়ের দুঃখ সহ্য না করতে পেরেই বোধহয় চলে গেলো।প্রীতি তাই মনে মনে ভাবে।
অথচ কি সুন্দর একটা ঝকঝকে জীবন ছিল ওর। জহীরের সাথে দেখা হওয়াটাও বলতে গেলে ঘটনা পূর্ণ।
বান্ধবী স্বাথীর বাসায় এসেছিল আড্ডা মারবে বলে। সেদিন ছিল রোববার। এক ঘেয়েমী থেকে একটু নতুনত্বের সাধ পাবে এই আশায়। ছাদের উপর আড্ডাটা ভালই জমেছিল। বাঁধ সাধলও ধমধম পায়ের আওয়াজে।
ও তুই এখানে? বলে শ্যামলা রঙের হাল্কা পাতলা ছেলেটা তাকালও ওদের দিকে।
তা এতো আওয়াজ করছ কেনও?
তুই না চা খাওয়াবি বলেছিলি।
নেও নবাব পুত্র এসেছে, উনাকে এখন চা খাওয়াতে হবে।
ওহো, পরিচয় করিয়ে দেই, আমার কাজিন, জহীর। থাকতো বোস্টনে। এখন তল্পিতল্পা গুটিয়ে চাকরি নিয়ে নিউইয়র্কে এসেছে। ছুটির দিন এসেছে চাচিকে দেখতে। আর এ হোলও—
থাক তুমি যাও আমি পরিচয় করে নেবো।
আমিও তোকে সাহায্য করি ? বলে উঠতে যাচ্ছিল প্রীতি।
আপনার আবার কি হোলও, ও একাই পারবে, আপনি বসুন।
কেনও জানি প্রীতি উঠতে যেয়েও উঠতে পারলনা । ওর কাছে মনে হোলও জহীরের চোখ দুটোতে মায়া মেশানো। আঁটকে গেলো সে।
কতদিন এসেছেন এখানে। এ যেন কথা বলতে হয় তাই বলা।
দুই মাস হোলও। লং আইল্যান্ড সিটি তে বাসা নিয়েছি। আসেন একদিন। চমৎকার ভিউ। নদীর ওপারে আকাশ চুম্বী দালান। রাতের ম্যানহাটন। অপূর্ব।
এক অপরিচিতা নারীর সাথে অবলীলাক্রমে কথা বলে গেলো। আর সে কেন পারছে না ওভাবে কথা বলতে?
না, কথা আর বলা হোলও না। স্বাথী চা নিয়ে এলো।
সন্ধাও ঘনিয়ে এলো। আবার উঠার পালা।
চলুন আপনাকে নামিয়ে দিয়ে আমিও ট্রেন ধরব।
“তোমার মা কেমন আছে?”
ভাবনা থেকে সরে এসে তাকাল রহিমা খালার দিকে। বয়সে মার থেকে কিছুটা বেশিই হবে। অথচ উনি দিব্যি চলে ফিরে বেড়াচ্ছেন এই শীতের মধ্যে।
“খুব একটা ভালো নেই। বাতের ব্যথা টা বেড়েছে। হয়তো ঠাণ্ডার জন্য”।
“তোমার মা কে বল, আমি যে ঔষধ টা খাচ্ছি সেটা খেতে”। বলে ঔষধের নামটা বলল।
“বলব খালা”। বলে আবারও হাটতে শুরু করলো প্রীতি।
আজ যেন পথ শেষ হতে চাচ্ছে না।
সেদিনও জহীর বলেছিল, আচ্ছা এই পথ যদি শেষ না হয়।
তাহলে আমাদের মিল হবে না। পথের শেষেই তো বাসস্থান। সেই বাসস্থানই যদি না হলও তবে মিল কোথায়।
কি সুন্দর সে কথা বলতে শিখে গিয়েছিল। কথার পিঠে কথা বলতে পারতো। সে সবই জহীরের জন্য।
বাবা, মা বলেছিল, মাটির টুকরো ছেলে। কত বড় চাকরি করে অথচ কোন দাম্ভিকতা নেই।
বাবা মা কে পটিয়ে ফেলল কয়দিনে।
বাবা তো জহীর বলতে অজ্ঞান।
বাসায় এলে মা কত রকমের রান্না নিয়ে বসতো।
জহীর বাবা কে বলত, আঙ্কেল, এই নয়টা পাঁচটা চাকরি না করে ব্যবসা করেন।
না বাবা, ঐ রিস্ক নিতে রাজি নই। বেশ ভালো বেতন দেয় ওরা। আমার আর মা মনির বেতন দিয়ে বেশ ভালোই চলে যায় আমাদের। আর তাছাড়া হেলথ ইনস্যুরেন্স আছে। এদেশে এটা ছাড়া চলা মুশকিল। বয়স হয়েছে, ঔষধ পত্র তো প্রতিদিনই লাগে।
এই সব কত কিছু নিয়ে ওরা কথা বলতো।
একদিন বাবা প্রীতিকে ডেকে বলেছিল, এবার বোধহয় দিনক্ষণ দেখে কাজ টা শেষ করে ফেলা দরকার, মা।
প্রীতি জহীরকে সে কথা জানিয়েছিল।
একটু ইতস্তত করে জহীর বলেছিল, ঠিক আছে।
বেশি ধুমধান না করে, যথা সাধ্য যেটুকু না করলেই নয়, তাই করে বাবা প্রীতিকে উঠিয়ে দিয়েছিল জহীরের হাতে।
বড় নামকরা হোটেলে যেয়ে বাসর রাত করেনি, উঠেছিল জহীরের সাঁইত্রিশ তালার উপরে এপার্টমেন্টে।
আলো নিভিয়ে দিতেই দুরের ঝলমলে আলো এসে পড়েছিল ঘরটিতে। ঐ আলোতেই ওরা দেখছিল এঁকে অপরকে।
বিছানা এলোমেলো হয়ে গেলো, কিন্তু কোথায় যেন একটা অতৃপ্ত বাসনা রয়ে গেলো প্রীতির মনে। পূর্ণ হোল না সব সাধ।
আলুথালু বেশে সকালে উঠে পড়লো প্রীতি।
“কোথায় তোমার নাস্তার সরাঞ্জাম? দেখাও”।
পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে, ঘাড়ে চুমু দিয়ে বলেছিল, আজ তা হয়না সুন্দরী, বাহিরে কোথাও নাস্তা করে নেবো। গোসল করতে হবে কি?
কি জানি? যে খেলা দেখিয়েছ কাল রাতে। বলে মুচকী হেসে টাওয়েল টা নিয়ে চলে গেলো প্রীতি।
ভালবাসায় কোন কমতি ছিল বলে মনে হয়নি প্রীতির।
তবে রাত এলেই জহীর বলতো, মাথা ধরার ঔষধ টা দেবে? অসহ্য, এ আর পারছি না।
অনেক দিন এমনও হয়েছে, ডিনার শেষে, সব কিছু গুছিয়ে এসে দেখে, জহীর ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রীতি আস্তে করে বালিশটা টেনে নিয়ে পাশে শুয়ে পড়েত।
বছর কেটে গেলো, প্রীতির মনে হয়, সব কিছু থেকেও, কি যেন নেই। কেন? জিজ্ঞাসা করবে ভেবে ছিল।
তা আর করতে হলনা।
সেই দুর্যোগ পূর্ণ রাতটা এলো।
প্রীতি বসে বসে টিভি তে খবর শুনছিল। জহীর আসতে কেনও আজ দেরী করছি এই ভেবে সময় টা দেখল। এমন কিছু রাত হয়নি। আবারও মন দিল টিভির দিকে।
কিছুক্ষণ পরে দরজা খোলার শব্দ শুনল। জহীর সোজা চলে গেলো ওর বেডরুমে।
এমনতরও কখন হয়নি। একটু খটকা লাগলো প্রীতির।
উঠতে যাবে সেই সময় জহীর এসে বসলো একটু দুরে, কোন ভূমিকা না করেই বলল, তোমার সাথে কথা আছে।
কি ব্যাপার। সব ঠিক আছে?
না নেই। এটা আমারই অন্যায় তোমার উপর।
কি বলছ, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।
অনেক দিন ধরেই ভাবছি বলব, কিন্তু সাহস পাইনি। আজ আর না বললেই নয়।
জহীর তাকালও প্রীতির দিকে।
প্রীতি তার বুকের ধকধকানি শব্দ শুনতে পাচ্ছে। আয়নায় দেখলে দেখতে পেতো তার মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।
জহীর চুপ করে আছে দেখে প্রীতিই জিজ্ঞাসা করলো, তোমার কি অন্য কেউ আছে আমি ছাড়া?
আছে। তবে সে ভিন্ন।
প্রীতি তার রাগ সামলাতে পারলনা। চিৎকার করে বলল, হেঁয়ালি ছেড়ে সোজা উত্তর দাও।
বললাম তো, আছে, তবে সে মেয়ে নয়।
কি বলছ?
ঠিকই বলছি। আস্তে, নরম সুরে বলল জহীর।
ভেবেছিলাম তোমাকে পেয়ে হয়তো আমার পরিবর্তন হবে। আমি আমার অন্য দিকটা ভুলে যেতে পারব। পরিবর্তন আসবে আমার ভিতর। কিন্তু তা হলনা। আস্তে আস্তে তোমার প্রতি আকৃষ্ট টা কমে আসছে দেখে ভাবলাম, আর নয়, এবার সময় এসেছে বলার।
তার মানে তুমি আমাকে নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করছিলে। ছিনিমিনি খেলছিলে আমার জীবন নিয়ে। গরজে উঠলো প্রীতি।
আমি দুঃখিত।
দুঃখিত? You—– কথা শেষ না করে দাঁতে দাঁত ঘসতে ঘসতে দ্রুত পায়ে চলে গেলো তার ঘরে।
কিছুক্ষণ পর বেড়িয়ে এলো একটা সুটকেস নিয়ে।
জহীর বাঁধা দিল না।
সেই শেষ।
প্রীতি ফিরে এসেছিল বাবা, মার কাছে। জহীর যতটুকু দেওয়ার তার চেয়েও বেশি দিতে চেয়েছিল উকিলের মাধ্যমে।প্রীতি নেইনি। করুনা তার সহ্য হয়না।
বাসার সামনে টা অন্ধকার মনে হোলও আজ।
দরজা খুলল।
মা, এলি।
হাঁ, মা।
3 Comments
হৃদয়টাকে নাড়া দিয়ে গেল এই গল্পটা।খুব সাবলীল লেখা।
Vison bastob abong vison sundor akta lekha. Amar janamote arokom akta kahini ase.
Onek sundor ekta lekha. Mon suye galo.