বার্ধক্য!
আগে এই শব্দটা বন্ধু মহলে উচ্চারণ করতে শুনিনি।
ইদানীং শুনছি।
কথায় কথায় বলছে সবাই,বার্ধক্যে পৌছিয়ে গেছি। আর তো কয়টা দিন। তারপর সব শেষ। হিসেব নিকেশের খাতা কি শূন্য, নাকি ভালো কিছু যোগ হয়েছে তাতো জানার উপায় নেই। তবে ইদানীং ইনশাআল্লাহ কথাটা কথার শেষে অথবা কথার আগে যোগ হচ্ছে। কাজেই বোঝা যায় মনে ভয় ঢুকছে।
তাছাড়া টুপ টুপ করে বেশ কয়জন ঝরে পড়েছে। কারোর স্বামী কারোর সহধর্মিণী স্থান নিয়েছে বিশাল আকাশের নিচে।
অনেকেই যারা ছিল দুজন, কথায় কথায় ভরিয়ে রাখতো খাবার টেবিল, আজ টেবিলটা নীরবতায় আচ্ছন্ন। টেবিলে আজ আর হরেক রকমের খাবার নেই। নেই হরেক রকমের বাটী। আছে শুধু একটা প্লেট, তাড়ি মাঝে দুই একটা তরিতরকারি।
অনেকে বলে সময় টা খুব দ্রুত চলে গেছে।
হাঁ খুবই দ্রুত চলে গেলো।
সবার মনেই একই চিন্তা, বিছানায় যেন পড়ে না থাকি। কারো মুখাপেক্ষী যেন না হই।
কিন্তু এটা তো কারো হাতে নেই।
অনেকে যারা একা হয়ে গেছে, একা একা থাকে ছোট্ট দুই কামরার ঘর নিয়ে, তাঁরা ভাবে রাতের অন্ধকারে যদি সে চলে যায় দুর দুর দেশে, অথবা বুকের ব্যথায় এম্বুলেন্স ডাকতে যেয়ে হাত থেকে পড়ে যায় ফোনটা, তাহলে কত দিন পরে সবাই জানতে পারবে সে আর নেই তাদের মাঝে।
এই তো সেদিন, এই সেদিন মানে ছেচল্লিশ বছর আগের সেদিন, শাহাদত আর শান্তি ঘর বেধেছিল এই শহরে। পিছনে ফেলে রেখে এসেছিল বাবা, মা ভাই বোন, আত্মীয় স্বজন। চোখে ছিল স্বপ্ন। সেই স্বপ্নের তরী বেয়ে একদিন তাঁরা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই বিশাল শহরে।
সংসার বড় হোলও। ছেলে মেয়ে কে ভালবাসা দিয়ে মানুষ করলো। ওরা যার যার পায়ে দাড়িয়ে পড়লো। এবার বিশ্রামের পালা। কিন্তু বিশ্রাম পেলো কি?
সময় তোঁ বসে থাকে নি।
শাহাদত আর শান্তির চুলে পাক ধরেছে। বিশাল বাসাতে এখন মাত্র দুজন।
শাহাদত বলেছিল শান্তিকে, দেখো, দুজনে আমরা বেধেছিলাম ঘর, সেই দুজনই রয়ে গেলাম। মাঝ খানের বেশ কিছু বছর পুতুল খেলার মত দুটোকে নিয়ে খেলা করে কাটিয়ে দিলাম।
কিরে? অনেকক্ষণ ধরে তুই কি যেন ভাবছিস। চা তো ঠাণ্ডা হয়ে গেলো।
হাঁ। ভাবছি শাহাদত আর শান্তির কথা।
হঠাৎ?
কেন জানি খুব মনে পড়ছে ওদের কথা আজ।
শেষ যেদিন দেখা হয়েছিল, অবশ্য সেই দেখা যে শেষ দেখা হবে জানতাম না, বলেছিল অনেক কথা।
বলতে আপত্তি আছে কি? তুই তো ছিলি ওর সব চেয়ে কাছের বন্ধু।
না আপত্তি কি? শান্তির চলে যাওয়া টা সে মেনে নিতে পারেনি। সত্যি বলতে কি আমরাও যে ওকে খুব একটা সাপোর্ট দিতে পেরেছিলাম তা মনে হয় না।
তুই ঠিক বলেছিস। আমরা ওকে কাছে টানার পরিবর্তে দুরে সরিয়ে দিয়েছিলাম। ও লিখতে আরম্ভ করেছিল, আর আমরা উৎসাহ না দিয়ে, ঠ্যাটা উপহাস করতাম। বলতাম দেখো, শাহাদত ও লেখক হয়ে গেলো।
একদিন সন্ধ্যায় ওর বাসায় না বলেই চলে গিয়েছিলাম। কয়েক বার বেল বাজানোর পর দরজা খুলল। ঘর অন্ধকার।
কিরে আলো জ্বালাস নি।
অন্ধকার ভালো লাগে, বলে সে সুইচ টা টিপে দিল। কি মনে করে? বলে তাকাল আমার দিকে। চোখ লাল।
কেন আসতে নেই?
সে কথা তোঁ বলিনি। চা দেবো?
মন্দ না বলে আমি সোফায় বসলাম। বড় বাড়ী ছেড়ে দু কামরার একটা ঘরে থাকে। এই বাসায় আজিই আমার প্রথম আসা। দেখা হলে কোন রেস্টুরেন্টে বসতাম আমরা।
কিছুক্ষণ আমার দুজনেই চুপ। আমিই নীরবতা ভেঙ্গে বললাম, ইদানীং কিছু লিখেছিস।
হাঁ ওই করেই তো সময় কাটাই। ভাবছি আর নয়, কেউ পড়ে না।
আমি বেশ কয়টা তোর লেখা পড়েছি, সুন্দর সাবলীল লেখা।
হেসে বলল, তুই তো অতি ভদ্রলোক সামনা সামনি কারো মনে আঘাত দিতে জানিস না।
তোর সাথে তর্ক করতে আমি আসিনি। তা বুঝলি কি করে যে কেউ পড়ে না।
সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে খুব ভালো হয়েছে। কাগজে ধরাধরি করে ছাপানোর জন্য বলতে হয় না। ফেসবুকে দিয়ে দেই। নয়তো অন্য একটা মিডিয়া আছে সেই খানে।
তাহলে তো খুব ভালো। অনেক পাঠক তোর।
না পাঠক আমার নেই। থাকলে কি মাত্র দুই থেকে পাঁচটা লাইক পেতাম? বাদ দে ও কথা। রাতে যদি তুই খেতে চাস তবেঁ আমার জন্য একটু অসুবিধা হবে। আমার চাল চুলো কিছু নেই।
খেতে আসিনি, গল্প করতে এসেছি। বলে উঠে যেয়ে চা র কাপটা নিয়ে এলাম।
হঠাৎ ই ভয় ভয় করে কথা টা পাড়লাম । বললাম, অনেক দিন তো হোলও এবার কিছু একটা চিন্তা ভাবনা করলে পারতিস?
ও আমার দিকে তাকাল, মৃদু হেসে বলল, কেন? তোর হাতে আছে নাকি?
না না—কথা শেষ না হতেই বলল,
আমাদের এই সমাজ বড় সংকীর্ণ মনের। বিয়ে ছাড়াও ছেলে মেয়ের মাঝে যে সম্পর্ক গড়া যায় তা তারা মানতে রাজি না।
সম্পর্ক টা কি হবে? সাহস করে জিজ্ঞাসা করলাম।
বন্ধুত্ত। কথা বলার একটা সাথী। কোন দৈহিক সম্পর্ক নয়। পারবি মানতে তুই?
আমি পারলেও ওরা পারবে না। তোকে নিয়ে কুকথা বলবে।
তাহলে থাক, যেমন আছি এভাবেই কেটে যাবে বাকি কটা দিন।
আরও কিছুক্ষণ বসে উঠে পড়লাম সেদিনের মত।
বেশ কিছু দিন চলে গেছে, হঠাৎ একদিন দুপুরে শাহাদতের ফোন পেয়ে একটু ঘাবড়িয়ে গিয়েছিলাম।
বলল, যদি হাতে সময় থাকে তবে আমার বাসায় একটু আসিস, কথা আছে।
ওর গলার স্বর আমাকে সেদিন ভাবিয়ে তুলিয়েছিল।
এলাম। কি ব্যাপার ? জরুরী তলব কেন?
উত্তর দিল না সে। আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, তোকে একদিন বলেছিলাম আমার লেখার কোন পাঠক নেই।
ভুল বলে ছিলাম। আমার একজন পাঠক, না পাঠিকা ছিল। আজ তাও চলে গেলো।
আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। বললাম, আমি বুঝতে পারছি না তুই কি বলতে চাইছিস।
তবে শোন,
লেখক যদি পাঠকের কাছ থেকে ভালোমন্দ কিছু জানতে না পারে তবে তার উৎসাহ উদ্দীপনা নিভে যায়।
এমনি একদিন আমার একটা লেখা অদিতি সেন বলে একজন খুব প্রশংসা করলো।
একটু আশ্চর্য হলাম।
লিখতে হয় তাই লিখলাম , অনেক অনেক ধন্যবাদ।
সে লিখল, আপনার প্রতিটি লেখাই আমি পড়ি। খুব ভাললাগে।
যাক, তাহলে জানলাম আমার একটা পাঠক আছে।
সে লিখল, ফাসবুকে ফ্রেন্ডশিপ রিকোয়েস্ট করলে একসেপ্ট করবেন কি?
করেই দেখুন।
করলাম।
এরপরে মাসেঞ্জারে টেক্সটের মাধ্যমে কথা হয়। আমার লেখা গুলোর কনস্ট্রাকটিভ সমালোচনা করে।
একদিন লিখলাম, আপনার ফেসবুক প্রোফাইলে তো ছবি নাই। কোনদিন দেখা হলে চিনবো কি করে।
যেমন খুশি কল্পনা করে নিও, সেই কল্পনাই হবে সত্য।
বাহ! আপনি তোঁ রবি ঠাকুরের শাপমোচনের কোট করলেন।
হাঁ হাঁ করে হেসে বলল, ধরতে পেরেছেন।
এই রকম লেখা ছোড়াছুঁড়ি চলতো।
একদিন লিখলাম, আপনার সাথে দেখা করা যায় কিভাবে?
যদি ১৯ ঘণ্টা প্লেনে জার্নি করে আসেন তবে দেখা হবে।
মানে?
মানে আমি থাকি কলকাতায়।
সেই সুদুরে বসে আপনি আমার গুনগান করে যাচ্ছেন। কেউ কিছু বলবে নাতো?
আমাকে বলার মতো কেউ নাই। তাছাড়া বন্ধু কি শুধু ঘরের কাছেই হয়, দুরের লোক কি বন্ধু হতে পারে না?
এই ভাবে কথার পিঠে কথা চলতো।
একাকীত্তের কিছুটা অবসান হয়েছিল। মুখে না হয় নাই বা হোল কথা, লেখনীর মাধ্যমে সেটা ঘুচে গেলো।
জিজ্ঞাসা করলাম, কতদিন ধরে চলছে।
প্রায় তিন মাস।
বার বারই মনে হচ্ছে শেষে কিছু একটা আছে যার জন্য সে আমাকে ডেকে নিয়ে এসেছে। সেটা কি ?
শাহাদত আবার বলতে আরম্ভ করল,
দুই তিন দিন কেটে গেলো তার কাছ থেকে কোন লেখা এলো না। একটু অস্থির হলাম। নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম, হয়তো ব্যাস্ত।
তিনদিন পরে ফিরে এলো সে, “ আর বোধহয় লিখতে পারবো বলে মনে হচ্ছে না”।
কেন?
আপনাকে বলিনি, আমার হাতের মাসেল গুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে। তাই কদিন লিখতে পারিনি। জানি আপনি চিন্তা করবেন। আপনার সাথে লেখাতে কথা বলে নতুন জীবন পেয়েছিলাম। ভুলে গিয়েছিলাম আমার MS হয়েছে। পা দুটোতে আর আগের মত বল পাইনা। হয়ত হুইলচেয়ার ধরতে হবে।
আস্তে আস্তে চোখের দৃষ্টিও কমে আসছে।
তবে কি আমি অন্ধ হয়ে যাবো? আমি কি আর আপনার লেখা পড়তে পারবো না?
ঝাপসা চোখে লিখলাম, চিন্তা করবেন না। সমাধান তো নিশ্চয় আছে।
না, নেই। ডাক্তার বলে গেছে। শুধু সময়ের অপেক্ষা। এই লেখাই হয়তো শেষ লেখা। আপনি লিখবেন আমাকে, আমি ঝাপসা চোখে পড়ব। আর কথা দিন গল্প লেখা বন্ধ করবেন না।
মনে হোলও অনেকদিন পরে একটা বন্ধু পেয়েছিলাম, কপালে সইলো না।
এই কথা বলে শাহাদত উঠে চলে গেলো। বুঝলাম সে কেঁদে হাল্কা হতে গেলো।
আমি পাঁথর মত বসে রইলাম।
তোর সাথে কি শাহাদতের আর দেখা হয়েছিল।
না, আর হয়নি। ফোন করেছিলাম, Disconnected. বাসায় গিয়েছিলাম। সেখানে সে আর থাকে না।
তবে তার দেখা আমি পাবো।
কোথায়?
সেই খানে যেখানে তাকে আসতেই হবে। সেই সময়টাও খুব কাছে।
শুধু দুর থেকে আমি তাকে দেখবো।
হেঁয়ালি রাখ। বল কোথায়?
3 Comments
Anekdin por likhlen. Lekhata valo legese.jibon amoni.
বাহ্! ভালো লেগেছে গল্পটা।”বার্ধক্য”নামকরণটা একদম উপযুক্ত হয়েছে।একাকিত্ব জীবন অনেক কষ্টের।গল্পের ইতি টানা হয়েছে খুব নিপুন ভাবে।
Really very good touch of old age.very nicely describe this is life.