শেখর জানালা দিয়ে তাকিয়ে বৃষ্টি পড়া দেখছিল। এমন বৃষ্টি পড়া সে আগেও দেখেছে। আজ যেন একটু ব্যতিক্রম। বৃষ্টির দিনে অনেকের মন একটু ভরাক্রান্ত হয়ে ওঠে। অনেকে কাগজ কলম নিয়ে বসে, অনেকে বলে আজ খিচুড়ি খেলে মন্দ হতো না।
শেখরের ওসব কিছুই মনে হচ্ছে না। তাকিয়ে ছিল সে বাহিরে দিকে। বৃষ্টির জল চুইয়ে পড়ছিল তার রাস্তার পাশে রাখা গাড়ি টি বেয়ে।
আজকাল সে চালাতে পাড়ে না গাড়ীটা।
ডান পা টা ব্যথায় টনটন করে। মাজা থেকে পা পর্যন্ত। কোন রকমে পা টাকে টেনে এনে বসতে হয় চেয়ারে। অতি কষ্টে। বসার তারতম্য হলে চিৎকার করে ওঠে শেখর।
যে শেখর ঘুরতে ভালবাসে, যে শেখর অন্যদের কে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে দেশের বাহিরে। সেই শেখর আজ চেয়ে থাকে অন্যের মুখের দিকে।
সইতে পারে না সে।
দুই মাস আগের এক সকাল।
ঘুম ভেঙ্গে পাশের ঘড়ি টা হাতে নিয়ে দেখল সকাল নয় টা।
উঠতে হবে।
যেতে হবে পেনারা তে।
আরও চার জন বন্ধু আসবে। নাস্তা খাবে আড্ডা দেবে।
রবিবার। কারো কাজ নেই।
ডান পা টা উঠাতে যেয়ে ব্যাথা করে উঠলো। পাত্তা না দিয়ে বিছানা থেকে নামতে যেয়ে পা টা রাখতে পারলো না মেঝেতে।
মনে হোলও শেখরের কে যেন ওর পা টাকে মাজা থেকে দুমড়ে মোচরে ছিড়ে আনতে চাইছে।
চিৎকার করে উঠলো শেখর। কেউ শুনল না ওর ডাক। পড়ে যেতে যেয়ে বিছানা টাকে খামচিয়ে ধরল।
দম নিয়ে আস্তে আস্তে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল শেখর।
ডান পা টা দিয়ে মেঝের উপর চাপ দিয়ে দাঁড়াতে চাইলো সে।
পারলো না। ব্যথায় কুচকে উঠলো সমস্ত শরীর।
বেশ কিছুটা সময় পাড় হয়ে গেলো।
ব্যাথার প্রচণ্ডতা একটু কমে আসতেই আস্তে আস্তে হেটে এসে দাঁড়াল বাথরুমে। দাঁত মাজতে যেয়ে রেখে দিল ব্রাস টা। বাথটাবে যেয়ে গরম পানি টা ছেড়ে দিল।
পানি টা আছড়ে পড়ল শেখরের মাজা তে। দাড়িয়ে রইল শেখর। এক দুই করে দশ মিনিট কেটে গেলো।
ব্যাথা টা কমে এলো।
বেড়িয়ে এলো শেখর বাথরুম থেকে। দুটো টাইলিনল মুখে পুড়ে দিলো। ব্যাথার তীব্রতা কমে এসেছে।
হঠাৎ করে কেনও এমন হোলও বুঝতে পারলো না।
কবীর কল করছে। শেখর জানে কেনও। কোন সময় তার দেরী হয় না। ওরা অস্থির হয়ে গেছে।
আসছি, বলে ফোন টা রেখে দিলো।
দশ মিনিট পেড়িয়ে গেছে। যেতে লাগবে আরও দশ মিনিট।
কোন রকমে কাপড়টা পড়ে বেড়িয়ে পড়লো শেখর। গাড়ী চালাতে একটু অসুবিধা হচ্ছে মনে হোলও তার। মাজায় ব্যথা টা অতটা তীব্র নয়। তবুও মাঝে মাঝে নড়ে চড়ে বসতে হচ্ছে।
কি ব্যাপার? দেরী হোলও কেনও। তোমার তো দেরী হবার কথা নয়। বলে কফিতে চুমুক দিলো রফিক।
সকালের ঘটনা টা বলতেই বাবুল তার ডেনিশ টা অর্ধেক করে শেখরের প্লেটে দিতে দিতে বলল, কি বলও? তুমি যাচ্ছ প্রতিদিন জিমে, তোমার না আছে মেদ না আছে ভুঁড়ি। তোমাকে এই কথা বললে মানায়।
আমি ও তো তাই ভেবেছিলাম। কেনও হোলও বুঝতে পারছি না। বলে শেখর তার এগ সান্ডউইচে কামড় দিলো।
সোমবারে ডাক্তারের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করো। নার্ভের কোন ব্যাপার কি না বলা যায় না। সিরিয়াস হয়ে বলল এনাম।
বাংলাদেশ, ভারতের রাজনীতির আলোচনা শেষে, কবীর জানতে চাইল করোনাভাইরাস সম্পর্কে কারো কোন আইডিয়া আছে কিনা।
ও রকম কত ভাইরাস এসেছে গেছে বলে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলো রফিক।
এনামকে যেতে হবে মেয়ের বাসায়। কাজেই আড্ডা শেষ করতে হোলও। কবীর অবশ্য এতো তাড়াতাড়ি আড্ডা ভাঙ্গবে আসা করেনি।
আগামীকাল ডাক্তারকে কল করবে, কথা টা শেখরের দিকে ছুড়ে দিয়ে এনাম গাড়ী স্টার্ট দিলো।
কয়দিন বেশ ভালই কেটে গেলো। সকালে ব্যথা হয়,আস্তে আস্তে সেরে যায়। ভুলে গেলো শেখর এনামের কথা। ডাক্তার কে আর কল করা হোলও না।
করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে দেশে দেশে। নিউইয়র্ক বাদ গেলনা। মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। গভর্নর অর্ডার দিয়েছে লকডাউনের। ননএসেনশিয়াল সমস্ত দোকান পাট বন্ধ। হাসপাতালে প্রতিদিন শতশত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ভর্তি হচ্ছে। ইলেকটিভ সার্জারি বন্ধ।
ঠিক সেই মুহূর্তে শেখরের ব্যথা টা তীব্রতর হোল। মনে পড়লো এনামের কথা। দেরী হয়ে গিয়েছে।
ডাক্তার কে কল করে বলতেই বলল, আপনার MRI করতে হবে। আমি Script পাঠিয়ে দিচ্ছি।
সন্ধ্যায় কল পেলো শেখর। ডাক্তার বললও সিভিয়ার Spinal Stenosis হয়েছে। অপারেশন ছাড়া উপায় নেই। নিউরো সার্জেনের সাথে আলাপ করতে বললও।
ব্যথা বাড়ছে, সেই সাথে ছোট ছোট কাজ করা দুরহ হয়ে উঠছে শেখরের পক্ষে।
শেখরের মেয়ে থাকে সিটিতে।
বললও বাবা, চলে এসো আমার কাছে। একা একা থাকা উচিত না, তাছাড়া তোমার খাবারের ভাণ্ডার তো ফুরিয়ে এসেছে।
কে পাঠাবে খাবার? অপারেশনের তারিখ কবে পাবে কে জানে।
প্রস্তাব টা মন্দ নয়। কিন্তু নিজের স্বাধীনতাকে বর্জন করতে চাইলো না শেখর। খুড়িয়ে খুড়িয়ে প্রয়োজনীয় কাজ গুলি করতে পারে শেখর। নিচের ভাড়াটে প্রতিদিনই কিছু না কিছু খাবার দিয়ে যায়।
বাঙালি নয়। কেরালার।
বলেছিল শেখরকে, ভেবো না তুমি একা, আমরা তোঁ রয়েছি নিচে। কোন কিছু লাগলে আমাকে ডাক দেবে।
শেখরের মনে হোলও এমন ধরণের মানুষ পৃথিবীতে আছে বলেই পৃথিবীটা এখনো সুন্দর।
কোন কিছু করার নেই, শুধু বই পড়া, নচেৎ টিভি দেখো। ঠিক সেই মুহূর্তে নজরুলের কল এলো।
Creative একটা ছেলে। পেশায় Engineer. কিন্তু বিভিন্ন নাট্যগোষ্ঠীর সাথে জড়িত। লেখাতে দক্ষতা আছে। কয়েকটা বইও বেড়িয়েছে তার।
বলল, শেখর ভাই, সামনে বাংলা নববর্ষ, সবাই ঘরে বসা, ভাবছি কয়েকজন মিলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নববর্ষে কবিতার কিছু কিছু অংশ recite করে আর সেটা ভিডিও করে আমাকে পাঠালে আমি ঐগুলোকে কাটছাঁট করে YouTube এ দেবো।
কি বলেন?
চমৎকার আইডিয়া। বলে শেখর ভাবল কিছুদিন এই নিয়ে ব্যাস্ত থাকলে মন্দ হবে না। ব্যথাটা ভুলে থাকা যাবে।
যথারীতি সম্পন্ন হোল কাজটা। নজরুলের ব্যবস্থাপনায় সুন্দর ভাবে পরিস্ফুটিত হয়ে উঠলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নববর্ষে কবিতাটি।
দিনদিন নিউইয়র্কের অবস্থা খারাপের দিকে ধাবিত হচ্ছে। শেখরের জানাশুনা অনেকে হাসপাতালে। কেউ বা ICU তে ventilator এ, কাউকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে। দুই এক জন চলে গেছে ওপারে। মসজিদে প্রতিদিন এশার নামাজের পরে বয়ান হচ্ছে, হচ্ছে দোয়া। সবার মনে আতংক।
শেখরের মেয়ে তনুজা কল করেছে কয়েক বার। শেখর বাকা হয়ে শুয়েছিল ব্যথা টাকে উপশম করার জন্য। ফোন টা ছিল টেবিলে। ধরা হয়নি।
আবারও কল টা এলো।
তোমার কোন কথা আমি শুনছি না। এখনি কাপড় জামা নিয়ে চলে এসো। না এলে আমি আসছি তোমাকে নিতে। তনুজার হুকুম।
শেখর আর দেরী করেনি। চলে এসেছিল।
বৃষ্টি এখনো অঝোরে ঝরছে।
শেখরের চোখে জল।
খবর পেলো শেখরের অনেক প্রিয় খালাম্মা চলে গেলো দুর দেশে। সবাইকে ছেড়ে। ফিরবে না আর।
একটা অদৃশ বন্ধনে বাঁধা পড়েছিল শেখর খালাম্মার সাথে। দুই বার শেখরের সাথে বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। দুরপথে অনেক কথা হয়েছিল শেখরের সাথে। সেই থেকে দেখা হলেই জড়িয়ে ধরতেন শেখরকে। বলতেন, বাবা তুমি তো এলে না বাসাতে।
শেখরের বন্ধু বলত, আমাকে তো শাশুড়ি মা কোনদিন জড়িয়ে ধরে নি, আর আপনার কথা মা র মুখে মুখে।
সেই আপনজন চলে গেলো করোনাভাইরাসে। শেখর কি না কেঁদে পাড়ে?
এই করোনাভাইরাস কবে চলে যাবে কে জানে। আরও কত ক্ষতির সংখ্যা বাড়াবে কে জানে। কবে আবার আমরা একসাথে হতে পারবো কে জানে। বসে আড্ডা দেবো। গুনে দেখব কয় জন আছে কয় জন নেই। শেখর ভাবছে এইসব।
শেখর নিজের কথা ভাবে। সে কত ভাগ্যবান, মেয়ের কাছে আছে। মেয়ের কাছে থাকা আর মা র কাছে থাকার মাঝে কোন পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না শেখরের।
অনেকে হয়ত এতো ভাগ্যবান নয়।
করোনাভাইরাস দুরে সরিয়ে দিয়েছে এঁকে অপরকে। ইচ্ছে থাকলেও কাছে আসতে পারছে না।
অনেকে পড়ে আছে একা।
কবে হবে এর অবসান।
শেখর ভাবে, ওই পড়ে থাকা গাড়ী টাকে নিয়ে আবারও সে বেড়িয়ে পড়তে পারবে কিনা। পারবে কি? কবে?
3 Comments
May Allah bless you. Sob thik hoye jabe Inshallah. Khub sundar description.
লেখাটা পড়ে বারে বারে চোখ মুছতে হচ্ছে!!!
কিছু বলার ভাষা আমার নেই।এক কথায়”অপূর্ব”!!!
Sundor lekha.jibon amoni mene nite hoy.Tobuo shantona meyta maer moto. Valo laglo.