সাতদিন পর।
সকাল নয়টা।
শেখর উপর থেকে নেমে এলো। সেই অসহ্য যন্ত্রনা করা ব্যথাটা নেই। শেখর হাটতে পারছে। কাঁটা ছেড়ার জায়গা টায় এখনো ব্যাথা। না থাকার কথা নয়।
তনুজা বলেছে, আর যাই করো নিজের বাসায় তাড়াতাড়ি ফিরে যাওয়ার কথা ভেবো না। একটু সুস্থ হয়ে নাও।
ডাক্তার বলেছে, সময় দিতে হবে। আস্তে আস্তে এক পা দুই পা করে এগোতে থাকো।
শেখর নাস্তা শেষে বেড়িয়ে এলো রাস্তায়, করোনার ভয়ে লোকজন খুব একটা রাস্তায় নেই। মুখে মাস্ক পড়ে, মাথায় ক্যাপ লাগিয়ে দুই এক পা যেতেই ফোন টা বেজে উঠলো।
শেখর হেড ফোন টা কানে লাগিয়ে নিলো।
-কোথায় তুমি? জিজ্ঞাসা করল সে
-রাস্তায়।
-রাস্তায়? মানে? আতঙ্কিত স্বরে বলল সে।
-হাটতে বেড়িয়েছি। দেখি কত টুকু পারি।
-এতো তাড়াতাড়ি না বের হলেই কি নয়?
-ঠিক বলেছ, মনে হচ্ছে না আমি এখনো প্রস্তুত। একটু টান লাগছে পা টা তে। বলল শেখর।
কথা বলতে বলতে বাসার সামনে রাখা চেয়ার টা তে বসলো।
কতদিন এইভাবে তাকে চলতে হবে কে জানে।
-ডাক্তারের কাছে কবে যাবে? জিজ্ঞাসা করল ওপাশ থেকে।
-আরও এক সপ্তাহ পড়ে। উত্তর দিল শেখর।
-শোন, আগামীকাল তোমার খোঁজ নেওয়া হবে না। ব্যস্ত থাকব। সাবধানে থেকো। বলে ফোন টা রেখে দিলো সে।
কথা শেষে শেখর বসে বসে ভাবছিল ফেলে আশা দিনগুলোর কথা।
নিউইয়র্কে ফিরে এসে শেখর ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল কাজ নিয়ে। হঠাৎ এক সকালে কল এলো ।
-খবর কিন্তু আমিই নিলাম, চিনতে পারছেন?
– অত্যন্ত লজ্জিত, কল করব করব করে আর করা হয়নি। কথাটা সত্যি না, তাও বলল শেখর।
সেটা বুঝতে ওপাশের ( দুই ভুরুর মাঝে তিল, যেটা কিনা প্রথমে শেখর মনে করেছিল টিপ), সেই ভদ্রমহিলার দেরী হয়নি।
ফোনের ওপর প্রান্তে মৃদু হাসি।
-সত্যি বলতে কি, আপনি না সত্য কথা, সত্য করে বলতে পারেন না। বলে আবারও হাসল সে।
শেখর হেসে বলল, ক্ষমা চাইছি, যদি কিছু মনে না করেন দেখা হবে কি?
-আগামী কাল সন্ধ্যা ছয়টায়। কোন রকম সংকোচ না করেই রেস্টুরেন্টের নাম টা বললও ভদ্রমহিলা।
শেখর একটু আগেই এসেছিল। কর্নারের একটা টেবিল নিয়ে বসলো। ওখান থেকে রাস্তাটা দেখা যায়। আগে কখনও এখানে আসেনি।
শেখর খুব একটা রেস্টুরেন্টে খেতে আসে না। বন্ধু বান্ধব নিয়ে বেশির ভাগ সময় বাসাতেই আড্ডা দেয়।
হাত ঘড়িটা দেখল শেখর। পাঁচ মিনিট পেড়িয়ে গেছে।
-সরি, একটু দেরী হয়ে গেলো।
মুখ তুলে তাকালও শেখর। ট্রেনে দেখা চেহারার সাথে মেলানোর চেষ্টা করল। সেদিনের সেই পটভূমিকাতে ওই রূপটা মানিয়ে ছিল।
আজ ভিন্ন, চুলটা উপরে উঠিয়ে বাঁধা। মার্জিত ভাবে সাঁজা মুখমণ্ডল। দেখে ভালো লাগলো শেখরের। গলায় টপসের সাথে ম্যাচ করে স্কার্ফ বাঁধা।
-কি ব্যাপার? কি ভাবছেন। চেয়ার টা টেনে বসতে বসতে বলল সে।
-ভাবছি—কথা শেষ হওয়ার আগেই ওয়েটার এসে পাশে দাঁড়ালো।
মেন্যু টা দিয়ে জিজ্ঞাসা করলো কোন ড্রিঙ্কস খাবে কিনা।
-ক্লাব সোডা। বললও সে
শেখর অর্ডার দিলো ডায়েট কোক।
নিতান্তই সাদাসিধে কথা বার্তা দিয়ে শুরু।
শেখর জানে প্রথম পরিচয়ে কারোর পেশা বা কোথায় থাকা হয় এসব নিয়ে আলোচনা নয়।
আলোচনা করো, মুভি বা নতুন কোন নেটফ্লেক্সে আসা সিরিজ নিয়ে অথবা খেলাধুলা (যদি সে ইনটারেস্টেড হয়)।
কথাবার্তার মোড় ঘুরে গেলো যখন সে শেখর কে জিজ্ঞাসা করলো, তার বাসাতে কে কে আছে।
শেখর বলেছিল, সে একেলা, মেয়ে বড় হয়ে চলে গেছে তার পথে।
কথার প্রসঙ্গে কথা বলতে হয়, তাই জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনার?
-আপনার মতোই একেলা, তবে ঐ পথে পা বাড়াইনি। বলতে পারেন, ক্যারিয়ার নিয়ে এতো ব্যস্ত ছিলাম যখন চোখ তুলে চাইলাম, দেখলাম, সময় পেড়িয়ে গেছে।
কতক্ষণ সেদিন বসেছিল আজ শেখর মনে করতে পারল না।
তারপর প্রতি সপ্তাহে এক দুইবার দেখা হয়েছে। বসেছে কোন নদীর পাড়ে অথবা গাড়ীতে করে চলে গেছে দুরে।
আপনি থেকে তুমিতে চলে এসেছে।
ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে।
একে অপরের খোঁজ নিয়েছে প্রতিদিন।
তনুজার ডাকে ফিরে তাকালও শেখর। তনুজা বলল ও একটু বাহিরে যাবে, কাজেই শেখর যেন ভিতরে চলে আসে।
ভিতরে আসতেই দেশ থেকে কল এলো। শেখরের বোন। খবর দিল অতি পরিচিত একজন চলে গেলো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। বড় ভাবীর ছোট মামা। দেশে থাকতে শেখরের সাথে কথা হতো। যাওয়া আসা ছিল।
চেহারাটা মনে পড়লো শেখরের। আরও কতজন হয়তো চলে গেছে, সে জানে না।
শেখরের মনে হোলও এবার বাসাতে ফিরে গেলে একটু অসুবিধা হবে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে। অনেকদিন আছে মেয়ের কাছে।
ডিপেনডেন্ট হয়ে পড়েছে সে।
বলেছিল সে, পারবে তো বাসায় যেয়ে সবকিছু করতে। নাকি আমাকে এসে সাহায্য করতে হবে?
তুমি এলে তো মন্দ হয় না। সকালে এসে সন্ধ্যায় চলে গেলে। বলেছিল শেখর হাসতে হাসতে।
-আসবো। বন্ধুর জন্য এইটুকু না করলে চলে। ফোনে বলেছিল।
দুইদিন ওর কোন কল এলো না।
শেখর উদগ্রীব হয়ে কল করলো।
ওর গলার স্বর ভারী। দুই একবার কাশলো।
-কি হয়েছে? কল করনি কেনও? জিজ্ঞাসা করলো শেখর।
– তোমার এই অবস্থায় আমি তোমাকে দেখতে যেতে পাড়লাম না। পাছে কিছু হয় তোমার। আর আজ তোমার ইচ্ছে থাকলেও আমাকে দেখতে আসতে পারবে না।
-কি হয়েছে? ভয়ার্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করলো শেখর।
-আমাকে ভর্তি হতে হবে হাসপাতালে। বলল কান্না ভরা গলায়।
শেখরের মনে হোলও পৃথিবীটা দুলছে।
-আসবো, আমি তোমার বাসাতেই দেখা করতে আসবো। চোখ টা মুছে বলল শেখর।
-তাই যেন হয়।
সেই শেষ কথা হয়েছিল শেখরের সাথে ওর।
2 Comments
মনটা ভারাকান্ত হয়ে গেলো।উপসংহার তুমি খুব সুন্দর ভাবে শেষ করেছো।
Nice ending. Mon ta kharap hoye gelo. Asa korbo next episode valo khabar pabo.
Negative kisu r nite parsi na.