কাস্টমসের ধকল শেষ করে পাঁচ নম্বর carousel এর সামনে এসে দাঁড়ালাম। তখনও সুটকেস এসে পৌঁছায়নি। যখন পেলাম তখন বেশ কিছু সময় পেড়িয়ে গেছে।
এয়ারপোর্টের বাহিরে এসে দাড়িয়ে চারিদিকে তাকালাম। আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য লোক আসার কথা। কিন্তু চেনা পরিচিত কাউকে দেখলাম না।
আমাকে ঘিরে বেশ কিছু লোক। তারা চাইছে কে আমার সুটকেসটা নেবে। আমাকে পৌছিয়ে দেবে আমার গন্তব্য স্থানে।
যতবার বলছি, আমার লোক আছে, তোমাদের গাড়ী আমার লাগবে না, কিন্তু কে কার কথা শোনে।
একজন তো আমার হাত থেকে সুটকেসটা প্রায় নিয়ে নিয়েছিল, ঠিক সেই সময় শুনতে পেলাম উচু গলায় এক মেয়ের কণ্ঠস্বর, এই সড়ে যাও। ধমক দিলো ওদের কে।
আমি তাকালাম ওর দিকে। চিনতে পারলাম না।
কোন কথা বলার আগেই আমার হাত থেকে সুটকেস টা নিয়ে বলল,
– ছোট মামা অ্যান্টি পাঠিয়েছে আমাকে। বাসায় কেউ নেই যে আসবে তোমাকে নিতে। আমাকে তোমার একটা ফটো দিয়ে অ্যান্টি বলেছে চিনে নিতে। তা তুমি যে আবার দাড়ি রেখেছ তা তো জানিনা। সেই জন্যই তো একটু দেরী হয়ে গেলো খুজে পেতে। এক সাথে এতগুলো কথা বলে বলল, তাড়াতাড়ি পা চালাও। গাড়ীতে বসে কথা হবে।
সেই প্রথম দেখা তার সাথে। ইউনিভারসিটির শেষ বর্ষের ছাত্রী। এই বাসাতে যাতায়েত আছে।
আমার মন টা জয় করে নিতে খুব একটা সময় লাগেনি তার। মনে হোলও যেন সে আমার অনেক দিনের চেনা।
যতদিন ছিলাম সেই নিয়ে গিয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। বইয়ের দোকান থেকে আরম্ভ করে নতুন চশমা বানানোর দোকান পর্যন্ত। করিৎকর্মা মেয়ে। ওর অ্যান্টি কে মাঝে মধ্যে সাহায্য করে।
সুতীর শাড়ী, সুতীর সালওয়ার কামিজ ছাড়া অন্য কিছু পড়তে দেখিনি তাকে।
ভালো গান গায়। নিজেদের বাড়ীতে গানের চর্চা হয়।
যত দিন গেলো দেখলাম তার কুকুর, বেড়ালের উপর মায়া। ওদেরকে ভালবাসে।
মনে পড়ে গেলো আমার শৈশবে ছোট্ট একটা ছেলে আমার সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে গিয়েছিল একই ভাবে।
আমাদের বাসাতে কাজ করত আয়েশা। তার ছেলে বিলটু। ঘুরঘুর করতো আমার আশেপাশে।
আমার পড়ার টেবিলের পাশে চুপকরে বসে থাকতো।
মা র লুকিয়ে রাখা বিস্কিটের বাক্স থেকে বিস্কিট এনে ওকে দিতাম।
ও চোখ বড়বড় করে চারিদিকে চেয়ে ছোট্ট ছোট্ট দাঁত দিয়ে টুসটুস করে কামড়িয়ে খেতও।
ওর মা মাঝে মাঝে ডাক দিয়ে বলত, এই বিলটু, মামা কে বিরক্ত করিস নে।
না, সে বিরক্ত করতো না, শুধু চেয়ে থাকতো আমার দিকে। মায়াময় চেহারা।
স্কুল থেকে এসে ওকে নিয়ে যেতাম মাঠে। ও বসে থাকতো। আমরা ফুটবল খেলতাম।
একদিন সে চলে গেলো। চলে গেলো অনেক দুরে।
ওর মা র বিয়ে হোলও। দুরের এক গ্রামে।
গরুর গাড়ী এলো। ওরা উঠে বসলো। ওর মা কাঁদছে।
ও তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কি যেন বলতে চাইছে।
চোখের পানি মুছে ওকে যেয়ে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, তোকে আমি নিয়ে আসবো ওই গ্রাম থেকে।
না, আর আনা হয়নি। আর দেখা হয়নি।
এখনো সেই ছোট্ট দাঁত দিয়ে কুচকুচ করে বিস্কিট খাওয়া আমার চোখের সামনে ভাসে।
এতদিনে অনেক বড় হয়ে গিয়েছে বিলটু। আমার কথা হয়ত তার আর মনে নেই।
-মামা, কি ভাবছ? তোমার না রেডি হয়ে থাকার কথা। নৃত্যাঞ্চল গোষ্ঠীর নাচের অনুষ্ঠান দেখতে যাবো?
-তাইতো? বলে তাড়াতাড়ি হাতের কাছে যা পেলাম পড়ে নিলাম।
-একি? এই বেশে যাবে নাকি তুমি? পাঞ্জাবি নাই? বলে তাকালও আমার দিকে।
– পাঞ্জাবি আনবো কেনও এখানে। আমি কি বিয়ে বাড়ীতে যাবার জন্য এসেছি নাকি? হাসতে হাসতে বললাম তাকে।
বেরিয়ে গেলো সে ঘর থেকে। কিছুক্ষণ পর ফিরে এলো একটা পাঞ্জাবি নিয়ে। লালের উপর কাজ করা।
-এই কটকটে লাল আমাকে মানাবে না। আমার বয়স টা কত তা তুই জানিস? বললাম,
কিন্তু কে কার কথা শোনে। অগত্যা ওটা পড়েই রওয়ানা দিলাম।
সুন্দর একটা অনুষ্ঠান দেখে যখন বের হলাম তখন সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই।
অনেক কে সে চেনে, তাই হাই, হ্যালো বলতে বলতে আরও কিছুটা সময় ব্যায় হোলও।
-তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আমাকে এক বন্ধুর বাসাতে যেতে হবে। বলে সে রিক্সার উদ্দেশে হাত উঠালো।
আমি একাই চলে যেতে পারবো বলতেই সে ধমকের সুরে বলল, জানো, এখানে কতকিছু ঘটছে ইদানীং?
আমার আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগলো। বললাম, এখানে আমার জীবনের অনেকটা সময় কাটিয়েছি তা জানিস।
অগত্যা সে একটা রিক্সা ঠিক করে দিল। বলল, পৌছিয়েই যেন আমি তাকে কল করি।
রিক্সা ডিমে তেতালে চলেছে। আমারও তাড়া নেই। চারিদিকে তাকিয়ে দেখছি। যে শহর ছেড়ে গিয়েছিলাম, মনে হচ্ছে এই শহর সেই শহর নয়। অনেক নতুন নতুন রাস্তা, নতুন নতুন দোকান পাঠ। চেনা শহর অপরিচিত মনে হচ্ছে।
বড় রাস্তা থেকে রিক্সাটা ঢুকে গেলো এক গলিতে। ছোট,চিপা রাস্তা। দুদিকে নর্দমা। এ কোথায় এলাম। কোথা দিয়ে সে নিচ্ছে আমাকে। জিজ্ঞাসা করতে যেয়ে থেমে গেলাম। পাছে সে বুঝতে পাড়ে আমি এখানকার বাসিন্দা না।
মনে পড়ল, কে যেন বলেছিল, অনেক কিছু ঘটতে পাড়ে, Ransom, খুন খারাবি।
সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞাসা করলাম, ঐ বড় রাস্তা ছেড়ে এই গলিতে ঢুকলে কেন?
-ওই দিকে রাস্তা বন্ধ স্যার। আপনি হুড টা উঠিয়ে শক্ত করে ধরে রাখেন। সামনে আবার ঐ মানে—
ঠিক সেই সময় ফোন টা বেজে উঠল। অনীকা কল করেছে।
-মামা কোথায় তুমি?
-জানিনা।
-জানিনা মানে? উৎকণ্ঠা জড়িত স্বরে জানতে চাইল।
-ইংরাজি তে বললাম, গলিতে? যাতে রিকশাওয়ালা বুঝতে না পাড়ে আমার মনে ভয়ের সঞ্চারের হয়ছে।
-গলিতে? ঠিক আছে তুমি কথা বলতে থাকো। আর চারিদিকে নজর রাখো।
আমি তাই করলাম। হঠাৎ পাশের দোকান থেকে দুটো লোক দৌড়ে এলো। সামনে এগিয়ে যেয়ে পিছনে ফিরে তাকালও।
– এই এই এখনি ওরা আমাকে ধরবে। গলা দিয়ে যেন স্বর বের হচ্ছে না।
-কারা তোমাকে ধরতে যাচ্ছে? তুমি কি—
ওর কথা শেষ হওয়ার আগেই রিকশাওয়ালা বললও,
– স্যার, এই জাগাটা সুবিধার না। বলে একবার পিছনে ফিরে তাকাল সে।
আমার আত্মা তখন গলার কাছে।
ঝম করে শব্দ হোলও। আমি চিৎকার করে পড়ে যেতে যেতে সীটের পাশটাকে জোড়ে চেপে ধরলাম।
-আমি বলেছিলাম না স্যার এই জাগাটা সুবিধার নয়। গর্ত আছে। সেই জন্য আপনাকে বলেছিলাম শক্ত করে ধরতে।
ঐ যে, ঐ যে, আমরা বড় রাস্তায় এসে গেছি স্যার। বাঁক নিলেই আপনার বাসা।
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল আমার।
ফিরে এসেছি আমি। এয়ারপোর্টে সেই এসেছিল আমাকে বিদায় দিতে। বলেছিল, ছোটমামা আবার কবে আসবে।
-জানিনা।
ওর চোখ টা ছলছল করে ছিল হয়ত। প্রকাশ করতে দেইনি।
প্রায় ম্যাসেঞ্জারে কথা হয়। ভালোই আছে। ব্যাস্ত। সামনে পরীক্ষা।
এলো করোনাভাইরাস। দেশে দোকান পাঠ, ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গেলো। দিন আনে দিন খায় যারা তাদের ঘরে নাই চাল, নাই ডাল। বেরাল,কুকুর রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, খাবার পায় না।
আমরাও এখানে বন্দী।
হঠাৎ ই দেখলাম ফেসবুকে অনীকা আর কয়জন মিলে খুলেছে একটা সংস্থা। দেশের এই পরীস্থীতে গরীব আর পশু প্রানীদের সাহায্যার্থে।
নাম দিয়েছে এক বেলার অন্নপূর্ণা।
ও আমার কাছে চায়নি। আমিই পাঠিয়েছিলাম আমার সাধ্যমত।
প্রতি উত্তরে সে লিখেছিল,
ধন্যবাদ ছোট মামা! তোমার পাঠানো এই উপহার যে কত মানুষ ও প্রাণির কাজে লেগেছে! তোমার এই উপহার কাজে লেগেছে একজন দিনমজুরের, একজন গাড়ি হেল্পারের, জাহাংগীরনগরের চা ভাই কালাম ভাইয়ের,রাজশাহীর প্রাণিকল্যাণকারী এক গ্রুপের আর এক মায়ের ডায়ালিসিসে।
চোখে জল এলো।
এরা আছে বলেই দেশটা আজও সুন্দর।
মনে মনে বললাম, ভালো থাকিস। সাবধানে থাকিস।
উপরওয়ালাই তোকে পুরস্কার দেবে।
–
3 Comments
খুব সুন্দর! মেয়েটা আসলেই অন্নপূর্না।দশ হাতে সবকিছু সামলায়।ওর এই “ এক বেলার অন্নপূর্না”কে সেলুট জানায়।লেখাটা ভীষন ভালো লাগলো।
Nice writing. Eder ase bolei prithibi ekhono sundar.
এক বেলা অন্নপূর্ণা অনেক মানুষ ও অসহায় বোবা প্রানীদের সহযোগী হয়েছে সব সময়ই।
এর প্রতিদান নিশ্চয়ই তারা পাবেন।
অনেক ভালোবাসা ও শুভ কামনা রইল। ❤