দায়ী কে?

  -না, ছুয়োনা আমাকে। লালা ডগডগে চোখে ধমকের সুরে বলল আসমা।

আবু দুই পা এগিয়ে যেয়ে আবার পিছিয়ে এলো। এমন যে আগে বলেনি তা নয়। প্রায় প্রতিদিনই অফিসে যাওয়ার আগে এমন হয়। ঔষধ গুলো খাওয়াতে গেলে ছুড়ে ফেলে দেয়।

-ঐ ছাই ভস্ম কেনও আনো আমার সামনে? বলেছি না আমি খাবনা। বলে দুই হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে থাকে।

আবুর কোন কথা শুনতে চায় না আসমা। আবুকে কেনও জানি সহ্য করতে পারে না।

অনু কে ডাক দিলো আবু।

আঠারো উনিশ বছরের মেয়ে। মামা মামী বলে ডাকে আবু আর আসমা কে। বন্ধু আনিসের বাসাতে কাজ করতো। বিয়ে হওয়ার পরে চলে গিয়েছিল স্বামীর সাথে। বিয়েটা টেকে নি। বৌ পেটানও স্বামী। ওকে ছেড়ে চলে এসেছিল আবার আনিসের বাসাতে। বলেছিল, মামা জাগা হবে তোমার এখানে? দরকার ছিলনা আনিসের। তবুও বলেছিল, থাক কয়দিন, এর মধ্যে একটা ব্যবস্থা হবে তোর।  আর ঠিক সেই মুহূর্তে আবুর কল এসেছিল।

তাও তো একবছর হয়ে গেলো অনু দেখা শোনা করে। ঘরের কাজ পুরো টাই তার হাতে। সকালে নাস্তা দেওয়া থেকে আরম্ভ করে রাতের খাওয়া পর্যন্ত। আবু আসমা বেড়িয়ে যেতো কাজে। ফিরে এলে চা বিস্কিট এগিয়ে দিতো।

আসমার সাথে এক নিবির বন্ধন সৃস্টি হোলও। ওর কথা শোনে আসমা।

-মামী এসো, তোমার চুলটা আঁচড়িয়ে দেই। বলে আবুকে ইশারা করে চলে যেতে বলল।

আবু এসে দাঁড়ালো ব্যালকনি তে। ধোয়াটে চারিদিক। তার ভেতর দিয়ে সূর্যের এলো এসে পড়েছে সামনের টবে রাখা ফুল গাছ গুলোর উপর।

আজ রোববার।

 নিচের রাস্তায় গাড়ীর সংখ্যা কম। তবুও প্যে পু শব্দ শোনা যাচ্ছে। দুরে এ্যাম্বুলেন্সের শব্দ। রাস্তায় লাইট পোস্টের তারের উপর বসা অনেক গুলো কাক হঠাৎ করে কা কা করে উড়ে গেলো। ওরা খুজে বেড়াচ্ছে আবর্জনা।

আসমার পছন্দে কেনা এই ফ্লাট।

বিয়ের পরে ভাড়া বাড়ীতে ছিল বেশ কয়েক বছর। প্রতিদিন কিছু না কিছু সমস্যা লেগেই ছিল। বাড়িওয়ালাকে বললে একই উত্তর। অসুবিধা হলে অন্য বাসা দেখতে পারেন। আবুর মনে হয় আসমা ওর ঘরের লক্ষ্মী।

ও জীবনে আসার পর তড়তড় করে একটার পর একটা উন্নতি। এই ফ্লাটটা, তাও তো ওরই জন্য। তা না হলে সেদিন বসুন্ধরা মলে তার যাওয়ার কথা নয়।

আসমা বলেছিল, চলো মলে যাই, একটু কেনাকাটা আছে।

-না, আজ থাক। বলেছিল আবু।

-প্লীজ, চলো না। গলা জড়িয়ে ধরে আবদার করেছিল আসমা।

অগত্যা রাজি হোলও , একটা বেবী ট্যাক্সি ডেকে এসে নামলো বসুন্ধরা মলে।

আর ঠিক সেই দিনে, সেই ক্ষণে দেখা হয়েছিল আকমলের সাথে।

 কাঁধের উপর হাত পড়তেই চমকে পিছনে তাকিয়ে ছিল আবু,

-কি রে চিনতে পারছিস?

কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, বলল, আকমল না?

-চিনতে পেরেছিস তাহলে। আকমল কথা শেষ করে তাকাল আসমার দিকে।

-ওহ পরিচয় করিয়ে দেই। আমার অর্ধাঙ্গিনী। আসমা।

-সালাম, ভাবী, এই হতচ্ছাড়ার সাথে একই কলেজে পড়াশুনা করেছি। কলেজ শেষে ও চলে গেলো ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আর আমি চলে এলাম ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে । বলে হেসে উঠল আকমল।

-তা আছিস কোথায়? কি করছিস? জিজ্ঞাসা করলো আবু।

-এই তো বাড়ি ঘর বানাই, আর বিক্রি করি। হাসতে হাসতে বললও আকমল।

-তার মানে রিয়েলস্টেটের ব্যাপসা।

-বলতে পারিস। তা তুই আছিস কোথায়?

-কাজ না বাসার কথা বলছিস। প্রশ্ন ছিল আবুর।

-দুটোই।

-চাকরি করি একটা ফার্মে। আর থাকি শান্তিনগরে।

-শোন, এই আমার বিজনেস কার্ড। সময় করে কল দিস। গল্প করা যাবে।

আকমল চলে গেলো দরজা পেড়িয়ে। ওরাও এসে ঢুকল এক শাড়ীর দোকানে।

-কেমন আছেন আকমল ভাই? অনেক দিন পরে আসলেন। আসফু জিজ্ঞাসা করলো। দোকানের কর্মচারী।  ওর কাছ থেকেই বিয়ের সব শাড়ীগুলো কিনেছিল। তাও তো আজ অনেক বছর আগের কথা। মাঝে মধ্যে আকমল আর আসমা আসে, আসফুই ওদের কে দেখাশোনা করে।

বাসায় ফিরে এসে আসমা বলেছিল, তোমার ঐ বন্ধুকে বলও না একটা এপার্টমেন্টের কথা।

-ভাড়া নেবে নাকি কিনবে? উৎসুক নয়নে আসমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল আবু।

-দেখাই যাক না। জিজ্ঞাসা করতে তো কোন ক্ষতি নেই।

তিন চার দিন পর আবু কল দিয়েছিল আকমল কে। গুলশানের এক নম্বরে ওর বাসা।

বলেছিল, চলে আয়। ডিনার করব এক সাথে।

সাত তালায় ওর ফ্লাট। ফ্লাট নয়, স্যুইট। সুন্দর করে সাজানো। আকমলের রুচি আছে। ঘরের চারিদিকে চোখ দিলেই বোঝা যায়। লিভিং রুমের এক পাশে বেশ বড় অ্যাকোয়ারিয়াম। লাল নীল মাছ ঘুরে বেড়াচ্ছে।

-বল কি খাবি এই মুহূর্তে। ঠাণ্ডা না গরম।

-হার্ড কোর ড্রিংকসের কথা বলছিস? আবু জানতে চাইল।

– তা যেটা তুই চাস। চা, কফি, লাল পানি। হাসতে হাসতে আকমল তাকালও আসমার দিকে।

-কফি চলবে। উত্তরে বলল আবু।

-ভাবী আপনার জন্য-?

– কফিতে আপত্তি নেই। একটু চুপ করে আসমা বললও, এই বাসাতে আপনি একলা থাকেন?

-বাহ, অসাধারন, সরাসরি বৌ আছে কিনা জিজ্ঞাসা না করে কি সুন্দর জানতে চাইলেন। না, নেই। আমি একেলা।

ছিল এক সময় কিন্তু কপালে টিকলো না। কলীম বলে একজন আছে আমার ড্রাইভার সেই বাজার ঘাট করে দিয়ে যায় আর পেয়ারার মা, রান্না করে।

আসমা আর কথা বাড়াল না। শুধু উসখুস করতে লাগল কখন আবু কথা টা পারবে।

খাওয়ার টেবিলে আবু জিজ্ঞাসা করলো, কোন ফ্লাট আছে কিনা ভাড়া বা কেনার জন্য।

-আছে, তবেঁ একটা সমস্যা আছে।

-কি? অতি দ্রুত জানতে চাইল আসমা।

-এক ভদ্রলোক বায়না দিয়েছে, তারপর তার আর কোন পাত্তা নেই। এক সপ্তাহ পরে ওর বায়নার মেয়াদ ফুরিয়ে যাবে। যদি সে না কেনে তা হলে তোকে দিতে পারবো। অবশ্য যদি তোদের পছন্দ হয়। ফ্লাটটা এই বিল্ডিংএর পাঁচ তালায়।

যদি চাস তবে খাওয়ার পরে দেখাতে পারব বলে পেয়ারার মা কে ডাক দিল।

-কি রকম দাম হতে পারে আকমল ভাই। আসমা জিজ্ঞাসা করল।

-তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আগে দেখেন।

পছন্দ হয়ে ছিল আসমার। আকমল বন্ধুর বন্ধুত্ত রক্ষা করেছিল। আবু আসমা কিনতে পেরেছিল ফ্লাট টা।

-মামা তাড়াতাড়ি আসেন। ভয়ার্ত স্বরে ডাক দিল অনু।

-কি হয়েছে?

-মামী যেনও কেমন করছে।

আসমা জানালার শিক ধরে ঝাঁকি দিচ্ছে। চোখ মুখে ঘৃনা আর বিদ্বেষের ছাপ। চিৎকার করছে আর বলছে, ওরা আসবে, ওরা আবার আসবে।

-না কেউ আসবে না, আমি তো আছি তোমার কাছে। আসমা কে জড়িয়ে ধরতে চাইল আবু।

ঝটকা দিয়ে সরিয়ে দিল ওর হাত।

-তুমি কিচ্ছু করতে পারবে না। বলে ঘরের কোণে যেয়ে বসে রইল।

আবু তাড়াতাড়ি ডাক্তার কে কল দিলো। ওরই বন্ধু।

পরিমল এলো সন্ধ্যায়। তখন আসমা ঘুমাচ্ছে। প্রথম থেকেই আসমা পরিমলের চিকিৎসাধীন আছে। ঘুমিয়ে আছে তবু যেনও চেহারাতে ভয়ের ছাপ।

ওরা দুজন এসে বসল ব্যালকনি তে।।

-কি মনে হয় তোর? জিজ্ঞাসা করল আবু।

-ওর মনের ভিতরের জট টা না ছুটানো পর্যন্ত কিছু হবে বলে মনে হয় না। না ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আরও হিংস্রতা বাড়ছে। বাসাতে না রেখে অন্য কোথাও দিতে চাস। পরিমল জানতে চাইল।

-তার মানে তুই বলতে চাস পাগলা গারদে।

-ও ভাবে বলছিস কেন? তুই একা সামলাতে পারবি? তোকে তো কাজেও যেতে হয়।

-তা হয়, তবুও আমার সামনে ওকে রাখতে চাই। চোখের সামনে, দুরে নয়।  

বলে দুরে তাকিয়ে থাকল আবু।

-কি ভাবছিস? পরিমল জানতে চাইল।

– মনে পরে কি, তোর বিয়েতেই আসমা কে প্রথম দেখেছিলাম।

-পরে বৈকি। তুই আমার পাশে এসে জিজ্ঞাসা করেছিলি, আমার বৌ এর পাশে ঐ মেয়ে টা কে?

পরে আমার বৌ পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল ওর বান্ধবীর সাথে,

– হু, তারপর ছয়মাস যেতে না যেতেই ওকে ঘরে উঠিয়ে এনেছিলাম। তারপর প্রতিটি মুহূর্ত এক সাথে কাটিয়েছি। আস্তে আস্তে পনেরো টা বছর পাড় করে দিয়েছি। ঘরে আর কেউ এলো না বলে মন খারাপ করিনি। তুই কি মনে করিস ওটা একটা কারন?

-না সেটা কারন নয়। কারন যে কোন টা তা তুই ও জানিস আমি ও জানি। বলে থামলো পরিমল।

দুজনেই চুপ।

পরিমল নিস্তব্ধতা ভাঙ্গলও। বলল, ঘুমের ঔষধ টা বাড়ীয়ে দিচ্ছি। সময় করে আনিয়ে রাখিস।

ওকে বিদায় দিয়ে আবু আবারও এসে বসল ব্যালকনিতে।
 তাকালও রাস্তার দিকে, নিঃসঙ্গ একটা লোক একাকী পথে হেঁটে চলেছে। আবুর মনে হোলও ও  ঐ  লোকটির মত, নিঃসঙ্গ।

না, সে নিঃসঙ্গ ছিল না। সপ্তাহে দুই তিন দিন বাহিরে যেতো ডিনার করতে। আবু নিজেই গাড়ী চালাত। আসমার ডান হাতের আঙ্গুল গুলো আবুর চুলে বিলি কাটত।

 ডিনার শেষে এসে বসত নির্জন কোথাও, মনে হতো তাঁরা নতুন করে প্রেম করছে।

তারপর সেই রাত টা। গাড়ীর আলোতে দেখতে পেলো সামনে দাঁড়ানো—–

না,না,না চিৎকার করে উঠল আবু।

-কি হয়েছে মামা। দৌড়ে এলো অনু।  

– না কিছু না, তুই যা। কপালটা ঘেমে গেছে।

চোখ সরিয়ে নিলো রাস্তা থেকে।

-মামা, খাবার দিয়েছি টেবিলে, আসেন। বলল অনু।

অনু থাকে আসমার ঘরে। আবু পাশের রুমে। দরজাটা খুলে রাখে। যাতে কোন শব্দ হলে শুনতে পায়। ঘুম আসে না চোখে।

যদিও বা আসে দেখে হিংস্র দানবদের স্বপ্ন। ওরা তোলপাড় করে বেড়াচ্ছে। কেউ ওদেরকে বাঁধা দেয় না। বাঁধা দেবার কেউ নেই। ওরা তা জানে। আর জানে বলেই ওদের এই তান্ডপ নৃত্য।  

বেশ কিছুদিন ধরে আসমা কে একটু শান্ত দেখাচ্ছে। আগের মত ঔষধ গুলো ছুড়ে ফেলছে না। অনু যা বলে তাই শুনছে। আবু কে দেখলে চিৎকার করছে না। একি ভালো হয়ে যাওয়ার পূর্ব লক্ষন।

অফিসে যাওয়ার আগে পরিমল কে কল দিল আবু।

-মনে হচ্ছে ঔষধ গুলো কাজ দিচ্ছে।

-মানে? জিজ্ঞাসা করলো পরিমল।

– আসমা এখন অনেক শান্ত । দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বললও আবু।

-হু, চুপ করে রইল পরিমল, মনে হোলও কিছু ভাবছে সে।

-কিরে চিকিৎসা সার্থক শুনেও আনন্দ পাচ্ছিস না? 

-না, মানে, ঠিক আছে আমি দুই একদিনের মাঝে আসব দেখতে। ওর ঔষধ পত্র গুলো কোথায় থাকে?

-কেন?

– জানতে চাইছি।

-অনুর কাছে, কেন? জিজ্ঞাসা করল আবু।

– না এমনি।

কথা শেষে আবু বেড়িয়ে গেলো।

অনু দরজাটা বন্ধ করে দিলো।

দুদিন পর। আবু বের হয়ে যাওয়ার আগে আসমা ডাক দিলো পিছন থেকে।

সচরাচর এমন হয়না।

আবু ঘাড় ফিরিয়ে তাকালও আসমার দিকে।

-কিছু বলবে?

-তোমার কি আসতে দেরী হবে আজ।

-না, কেনও, কিছু লাগবে। জিজ্ঞাসা করলো আবু। একটু অবাক হোলও, চেহারায় সেই ভাব আসতে দিলো না।

-না, এমনি। বলে ওর ঘরের দরজাটা ভিজিয়ে দিলো।

তখন বাজে দুপুর একটা। আবু ব্যাস্ত কাজ নিয়ে।

অনুর কল।

-মামা, আপনি তাড়াতাড়ি বাসায় আসেন। কান্না কান্না স্বরে অনু বলল।

-কেন? কি হয়েছে? উৎকণ্ঠা আবুর কণ্ঠে।

-আমি দরজায় ধাক্কা দিচ্ছি কিন্তু মামি দরজা খুলছে না। তাড়াতাড়ি আসেন, কাঁদতে কাঁদতে বলল অনু।

আবু বেড়িয়ে এলো অফিস থেকে। কি ভাবে গাড়ী চালিয়েছিল সে নিজেও জানে না।

অনু দরজার সামনে বসে কাঁদছে।

আবু পকেট থেকে চাবি টা বের করলো।

হাত কাঁপছে।

দরজাটা খুলল।

আসমার নিষ্প্রাণ দেহটা ঝুলছে ফ্যানের সাথে।

লোকজন এলো, এলো আকমল, এলো পরিমল । ওরা আবুকে নিয়ে বসাল ব্যালকনি তে।

আবু তাকাল ওদের দিকে। রক্তশূন্য মুখমণ্ডল।

শুধু একটা প্রশ্ন জানতে চাইল সে,

– যারা ওকে সেই রাতে টেনে হেঁচড়ে গাড়ী থেকে নামিয়ে নিয়েছিল, তাঁরা আজও কেনও হেসে খেলে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

বল, কেন? কেন?   

You may also like

2 Comments

  1. সময় উপযোগী গল্প।চতুর্দিকে কেবল হিংস্রতার খবর।দারুন হয়েছে গল্পটা।খুব ভালো লাগলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *