টুনি পাগলি

“এই টুনি তুই মেয়ে পেলি কনে”, চিৎকার করে বলতাম আর ওর পিছনে পিছনে হাঁটতাম।

আমার মতো তিন চার জন, বয়স ছয়, সাত। টুনি ওর মেয়েটাকে কোলে করে ফিরে চাইত আমাদের দিকে। চোখে আগুনের হল্কা। মাঝে মাঝে বলত,

-যা, তোদের মা কে যেয়ে জিজ্ঞাসা কর। 

কেন বলতাম, এর মানেই বা কি কিছুই বুঝতাম না। সবাই বলতো, আমরাও বলতাম।

বয়স টা যখন চোদ্দর কোঠায় পৌছাল তখন কথার মানে টা বুঝতে পারলাম, আমরা তখন আর ওর পিছনে যাই না। সেই জায়গায় এসেছে অন্য আরেক দল।

দেখতে দেখতে অনেক গুলো বছর পেড়িয়ে গেলো। আসা যাওয়ার পথে টুনি কে দেখি। আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। আমি লজ্জায় মুখ নিচু করে পাশ কাটিয়ে চলে যাই। ভাবি ওকি আমার সেই ছয় সাত বছরের চেহারা টা মনে রেখেছে?

 ছোট্ট শহর, সবাই তো সবাই কে চেনে। লজ্জাটা আমার সেই জন্য।  মেয়েটা এখন আর কোলে নেই, হাত ধরে হাটে।  

তারপর আমি এই শহর ছেড়ে চলে গেছি।

বহু দূরে।

অনেক দিন পর ফিরে এলাম দেশে। এলাম আমার সেই হারিয়ে যাওয়া ছোট্ট শহরে। উঠলাম আমার এক বন্ধুর বাসায়। পিছনে ফেলে আসা দিন গুলো মনের পর্দাতে ভেসে উঠল। আলাপে আলাপে প্রসঙ্গ এলো টুনি পাগলির কথা।

-কোথায় সে? জিজ্ঞাসা করলাম।

-চলে গেছে এই ধরাধাম থেকে। বলল আমার বন্ধুটি।  

-ওর সেই মেয়েটা?

-আছে, এই তো দুই মাইল দূরে, থাকে সাকোর পাড় গ্রামে । বলল বন্ধু টি।

-যাওয়া যায় সেখানে? হঠাৎ প্রশ্ন করলাম আমি।

-যাওয়া যায়। তবে ওর বাসা আমি চিনি না। খোঁজ নিয়ে বের করতে হবে।

-ওঠ চল, আমি এখনি যাবো। বলে তাকালাম ওর দিকে।  

 কেনও জানি টুনির চেহারা টা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল। রাগান্বিত নয়। অসম্মানে কুচকিয়ে যাওয়া চেহারা। যার জন্য দায়ি আমরা।

 ছোট বেলার অনেক স্মৃতি ভোলা যায়না। ফিরে ফিরে আসে। হয়ত আমার অবচেতন মনে ফেলে আসা টুনির চেহারা টা দাগ কেটে ছিল। ওর প্রসঙ্গ উঠতেই আমার মনে হোল ওর উপর যে অন্যায় আমরা করেছিলাম তার প্রায়শ্চিত্ত করতে যাবো আজ তার মেয়ের কাছে, বলব, আমি দুঃখিত।     

রিক্সা ডেকে উঠে পড়লাম আমরা দুজন। সাকোর পাড় গ্রামের ভিতরে রিক্সা যেতে পারলো না।

 পায়ে চলা পথ। নেমে পড়লাম।

 বন্ধুটি অনেক খোঁজ নিয়ে বের করলো বাসাটা। উঠানে দাড়িয়ে জোরে বলল, কেউ আছে বাসাতে?

 ওর গলার স্বর সব সময় উচুতে খেলা করে।

বেড়িয়ে এলো পাতলা গড়নের একটি মেয়ে। বয়স বোঝা যায় না। এক পেচে পড়া শাড়ী।

কাকে চাই? জিজ্ঞাসা তার।

তুমি কি টুনির মেয়ে? বন্ধুটির প্রশ্ন

-হাঁ। বলে অবাক দৃষ্টি তে তাকিয়ে রইল আমাদের দিকে।

এবার আমি এগিয়ে গেলাম। বললাম, তোমার মাকে আমি চিনতাম। ছোট বেলায় খুবই খারাপ ব্যবহার করেছি তার সাথে। তাকে তো পেলাম না। বলতে পারো ক্ষমা চাইতেই এসেছিলাম। 

সে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।

অবশেষে বলল, শুধু আপনি নয়, আমার মা কে অনেকেই খুব খারাপ কথা বলেছে রাস্তা ঘাটে। কোন কিছু না জেনে। আমি তখন ছোট বুঝতে পারিনি কি বলছে ওরা, আপনারা। 

কেন? বলতে পারেন, কেনও এতো খারাপ কথা বলতেন?

ওর প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে পারিনি। শুধু এই টুকুই মনে হোল , ওর মার কাছে আমি অপরাধী রয়ে গেলাম সাড়া জীবনের জন্য।

বললাম, তোমার মা থাকলে তার কাছে ক্ষমা চাইতাম, তা যখন হলনা পারলে তুমি ক্ষমা কর।

সে ঘরের ভিতর চলে গেলো, ফিরে এলো একটা মাদুর নিয়ে। পেতে দিয়ে বলল, বসেন, সব বলব আজ আপনাদের কে।

মা আমাকে সব বলে গেছে। সব ঘটনা। কেন মা কে বাড়ী থেকে বেড়িয়ে যেতে হয়ে ছিল।

শোনেন।

বলো। বলে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

নানা  ছিল গাদনপুরের চেয়ারম্যান। প্রতিপত্তি ছিল। লোকে যেমন সামনে সম্মান করতো, পিছনে তেমনি ভেংচি কাটত। শত্রুর তার অভাব ছিলনা। গদী রাখতে হলে অনেক ভাল মন্দ লোক কে পুষতে হয়। নানাও পুষেছিল অনেক কে। ওই গদী টিকিয়ে রাখতে যেয়ে সে মা কে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এক মদখোরের কাছে বিয়ে দেয়। নানী বাধা দিয়ে ছিল। কিন্তু পারেনি। মা ছিল নানার একমাত্র মেয়ে। এই গদীর লোভ বড় ভয়ঙ্কর। 

আমি ঐ মদখোরের মেয়ে।

কোন এক সময়ে নানার সাথে আমার বাপের টাকা পয়সা নিয়ে মনোমালিন্য হয়। নানা তার লোকজন দিয়ে চেম্বার থেকে বের করে দিয়েছিল ঐ মদখোর কে। 

এই বলে থামল সে।

আমি পিছন ফিরে চাইতেই দেখলাম লুঙ্গি পাঞ্জাবি পড়া একজন দাড়িয়ে।

টুনির মেয়ে বলল, আমার স্বামী। এখানকার পাঠশালাতে মাস্টারি করে।

এগিয়ে আসতেই আমার উঠে দাঁড়ালাম।

আমার নাম কছম আলী, এখানে কি ব্যাপারে?

কিছু বলার আগেই টুনির মেয়ে বিস্তারিত সব বলল।

কছম আলী শুধু একটা কথাই বলল, অনেক কাঁদিয়ে ছিলেন আমার শাশুড়িকে। বলে ঘরের ভিতর চলে গেলো।

আমরা বসলাম। কিছুক্ষণ কারো মুখে কোন কথা নেই।

আমিই  মৌনতা ভাঙলাম, জিজ্ঞাসা করলাম, তারপর?

 সেই সময় আমার মা অন্তঃসত্ত্বা। একদিন বাবা নানার উপর প্রতিশোধ নিতে যেয়ে  মা কে বের করে দিলো বাসা থেকে মিথ্যা দোষারোপ দিয়ে। অস্বীকার করলো আমার অস্তিত্ব। বলল সে আমার পিতা নয়।

বলেছিল, আমার মা কুলাঙ্গার।

মা এসে উঠল নানার বাসায়। কিন্তু সেখানে সে থাকতে পারলনা। আমার বাবা,  মার নামে মিথ্যে সব ঘটনা রটনা করতে থাকল। বিষিয়ে উঠল বাসার পরিবেশ।

এক রাতে মা এক কাপড়ে বেড়িয়ে পড়ল।  চলে এলো বহু দূরে। আশ্রয় নিলো  এক দুঃসম্পর্কের খালার বাসায়।

সেখানেই আমার জন্ম। বাবার কোন সন্ধান না থাকাতে লোকে মার নামে মিথ্যা অপবাদ দিতে থাকল। সেই অপবাদের বোঝা মাথায় নিয়ে, ভিক্ষা করে মা আমাকে তিলেতিলে মানুষ করেছিল। 

আমার মা নষ্টা নয়। আমার কাছে আমার মা দেবী, আপনাদের মার মতই সেও একজন মা। সারা জীবন শুধু অপবাদই পেয়ে গেল।

এই বলে একটু থামতেই চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি বেড়িয়ে এলো। আমি আমার হাতের রুমাল টা এগিয়ে দিলাম।  

আমার বন্ধু উঠে উঠানের এককোণে যেয়ে দাড়িয়ে রইল।

জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার নানা খোঁজ নেই নি?

-না, জানিনা সে বেচে আছে কিনা। তিক্ততা মেশানো গলার স্বর। 

বললাম, আমি আবারও ক্ষমা চাইছি। ছোট বেলার ঐ খেলা বড় নিষ্ঠুর খেলা ছিল। আজ তা বুজতে পারছি।

বলে তাকালাম ওর দিকে।  সে চেয়ে রইল দূরে, দুর আকাশের কোনে।

আমার চোখের কোণটা যে ভেজেনি তা নয়।

উঠে দাঁড়ালাম।

সে শাড়ীর আচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ঘরের ভিতর চলে গেলো।

You may also like

4 Comments

  1. ছোটবেলায় অনেক কিছুই আমরা খেলার ছলে না বুঝে করে থাকি।কালের বিবর্তনে সেটা বোধগম্য হয়।খুব ভালো লাগলো গল্পটা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *