গলির সেই বাড়ীটা

    গলি টা তে পা দিতেই কাঞ্চনের গা টা ছমছম করে উঠলো। আলো অন্ধকারে ঘেরা রাস্তা। দুই দিকে ছোট ছোট পান বিড়ির দোকান। একটা খাওয়ার দোকানে পরাটা লুচি ভাজছে একটা ছেলে। ষণ্ডা মার্কা দুটো লোক দাড়িয়ে কি যেনও বলা বলি করছে। কাঞ্চনের দিকে তাকাল, ফিসফিস করে কি যেন বললও ওরা। বেশ কিছু লোক একটা বাড়ীর দরজা দিয়ে আসছে যাচ্ছে। যে বেড়িয়ে আসছে সে চারিদিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিচ্ছে। যে ঢুকছে সেও তাই করছে।

কাঞ্চন বুঝতে পেরেছে এই সেই বাড়ি।

দুই বার ঢোঁক গিললও, বুকের ভিতর খালি খালি লাগছে। পাশের দোকানের হাড় জিরজিরে লোকটা তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

কাঞ্চন ডান হাতটা দিয়ে মুখ টা মুছে নিলো। পকেটে হাত দিয়ে দেখল মানিব্যাগ টা ঠিকমত আছে কিনা। টিভি তে দেখা সেই লোকটার কথা মনে করলো। সেও যখন প্রথমবার নিশিদ্ধ পল্লীতে এসেছিল,তারও বুক কেঁপেছিল। কাঞ্চন সাহস সঞ্চয় করার চেষ্টা করল।

ইদানীং ইনটারনেটের মাধ্যমে অনেক ওয়েবসাইটে যাওয়া যায় যেখানে আছে এডাল্ট মুভি। কাঞ্চন দেখেছে সেই মুভি। শরীরের ভিতর উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল। গুগুল করে জেনেছে কোথায় গেলে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারবে।

তারপর বুক ফুলিয়ে বন্ধুদের কাছে বলতে পারবে ওর অভিজ্ঞতার কথা। বলবে লোমহর্ষক কাহিনী।

-এই ছোড়া এখানে দাড়িয়ে কি করছিস? বেটে, গলায় পুঁতির মালা, চোখ লাল, কপালে কাঁটা দাগ চেহারার লোকটা জামার কলার টা ধরে ধমকের সুরে বলল।

আমতা আমতা করে কাঞ্চন বুঝাতে চেষ্টা করল সে ভিতরে যাবে।

হাঁ হাঁ করে হেসে উঠল লোকটা।  

-ভিতরে যাবি? আয়, বলে হাত ধরে হেঁচকা টান দিয়ে ভিতরে নিয়ে এলো।

-ও মামি, বলে চিৎকার করে ডাক দিল লোকটা, দেখো কাকে নিয়ে এসেছি। বলে আবারও প্রান খুলে হাসতে লাগলো।

আলো আঁধারের মাঝে দেখা দিলো বয়স্ক এক মহিলা।

-এত চিৎকার করছিস কেন গরুর মত, বলেই কাঞ্চন কে দেখে বলে উঠল, ওমা এ ছোড়া এখানে কি করে?

-বুঝতেই পারছ, স্বাদ নিতে এসেছে। কোন ঘরে দেবে বলও, ডাক দাও।

কাঞ্চন ঘামতে শুরু করেছে। ভাবল দৌড়িয়ে বের হয়ে যাবে কিনা। পা যেন অবশ হয়ে গেছে। দৌড়ানোর শক্তি নেই।  

-পকেটে মাল আছে তোঁ? ভসভস করে মুখ দিয়ে পচা গন্ধ বের করে জিজ্ঞাসা করল ঐ কর্কশ চেহারার লোক টা।

কাঞ্চন পকেট থেকে টাকা গুলো বের করতেই মামি বলে ডাকা মহিলা ওর হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে নিলো।

-যা, চম্পা কে ডাক দিয়ে বল, ওর সোয়ামি এসেছে। বলে সে ঘরে ঢুকে গেলো।

কাঞ্চন ভয়ে ভয়ে চারিদিকে তাকিয়ে দেখল, চার পাঁচ টা মেয়ে, উগ্র সাঁজে সাঁজা, খিলখিল করে হাসছে। তার মধ্যে থেকে একটা মেয়ে বেড়িয়ে এলো।

-এই আমার নাগর নাকি আজ রাতের। বলে হেলতে দুলতে এসে কাঞ্চনের হাতটা চেপে ধরলও।

ওমা, এত ঠাণ্ডা বরফ। চলো, তোমাকে আমি গরম করব।

-না,না আমি চলে যেতে চাই। কাঞ্চন কান্না কান্না স্বরে বলল।

-তাতো হবে না বাছা, আমার রাত টা আমি মিছে যেতে দেবো না। এসেছ এখানে মৌজ মারতে, চলে যাবো বললেই কি যাওয়া যাবে। বলে ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো দরজার সামনে। ধাক্কা দিয়ে খুলল দরজাটা।

-এসো, আমাকে বেশি বিরক্ত করো না।

ভিতরে টেনে এনে ময়লা একটা বিছানাতে বসিয়ে দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।

কাঞ্চনের মনে হোল, আজ এখানেই সে শেষ। কেউ জানতে পারবে না ও কোথায়, ওর লাশ টা হয়তো কোন রাস্তার ধারে ফেলে রেখে দেবে।

-এই ছোড়া, ঝটপট কাপড় খুলে ফেলো। বলে সে তার নিজের শাড়ীটা এক টানে খুলে ফেলল।

কাঞ্চন তাকিয়ে রইল চম্পার দিকে।

চম্পা এগিয়ে এলো।  

কাঞ্চন থরথর করে কাঁপছে।

চম্পা আরও কাছে এলো। কাঞ্চনের মুখ টা ওর হাতের মধ্যে নিলো। তাকালও ওর চোখে দিকে।

-বয়স কত? কঠিন স্বরে জানতে চাইল।

-পনের। ভয়ে ভয়ে বলল কাঞ্চন।

-বড় লোকের বকাটে ছেলে? বলে প্যান্টের উপর দিয়ে জোড়ে চাপ দিলো ওর পুরুষাঙ্গে।

রক্তাত চোখে বলল, এই ছোট ইঁদুর টা নিয়ে এত বাড়াবাড়ি। বলে ঘরের কোনে পড়ে থাকা শাড়ীটা এক পেচে পড়ে নিলো।

তাকাল কাঞ্চনের চোখের দিকে। দেখল ওর ভয়ার্ত চেহারা টা। পাশে পড়ে থাকা চেয়ার টা টেনে এনে বসলো ওর সামনে।

তারও বয়স ছিল পনের। বাবা নাম দিয়েছিল সখিনা। বাস করতো ছোট্ট একটা গ্রামে, নাম সুন্দরপুর। গ্রাম বলা চলে না, বলতে হবে ছোট শহর। এখানে অনেকের ছিল পাকা ইটের বাড়ি।  ছিল স্কুল। ওদের বাড়ীটা ছিল মাটির। বাবা ছিল ফেরিওয়ালা। দোরে দোরে বিক্রি করে বেড়াতো বিভিন্ন জিনিষ। সন্ধ্যায় ক্লান্ত হয়ে ফিরত। মা গামছা টা এগিয়ে দিতো। অভাব ঢোকেনি এই বাড়ীতে।

পাশের বাড়ীর মেয়ে সুফিয়া ছিল ওর বান্ধবী। একই বয়সের। ওদের বাসায় বসে আড্ডা দিতো।

মাঝে মাঝে সুফিয়ার ভাই তোবারক ঐ ঘরের ভিতর এসে কিছু খোজার ভান করে খুজে বেড়াতো না জানা জিনিষ টা।

ওরা দুই বান্ধবী মিটমিট করে হাসত।

ঐ সুন্দর সংসার একদিন ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেলো। সখিনার বাবা কাঠফাটা রৌদে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলো রাস্তায়। ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো তার জিনিষপত্র। আর উঠল না। কে যেনও সখিনার মা কে খবর দিলো। পড়ে থাকা সখিনার বাবা কে ধরে সে অনেক কাঁদলও। সখিনার চোখের পানি শুখিয়ে গেছে। ও কাঁদেনি। ও পাথরের মত দাড়িয়ে ছিল।

অভাব এসে টোকা দিল দরজায়। নুন আনতে পান্তা ফুরাল। অনেকে অনেক পরামর্শ দিলো। অবশেষে আবার বিয়ে করল সখিনার মা।

সম্বন্ধ টা এনেছিল পাশের বাড়ীর জমীরের মা। তার দুঃসম্পর্কের ভাই। বছর তিনেক হোল বৌ এর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। সেই ভাই এসেছিল জমীরের মার বাসায়। দেখেছিল সখিনার মা কে, দেখেছিল সখিনা কে।

সেই বলেছিল জমীরের মা কে।

-কি বলও বোন, বিয়ে বসবে ও?

জমীরের মা বলেছিল, জিজ্ঞাসা করে দেখি।

অভাব যখন আসে তখন সব দিক শুধু অন্ধকার মনে হয়।

মন না চাইলেও বিয়ে বসতে হয়েছিল সখিনার মা কে। প্রথম থেকেই পছন্দ হয়নি লোক টাকে সখিনার। গুন্ডা মার্কা চেহারা।  কেমন যেনও ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে।

অস্বস্তি লাগে সখিনার।

ভেবেছিল, মা যদি সুখে থাকে ওর কি আসে যায়। লোক টা বের হয়ে যায় সকালে ফেরে রাতে। কি করে জানতে ইচ্ছে করে নি সখিনার। লোকটার নাকি টাকা পয়সা আছে শুনেছে।

দুটো ঘর। একটা ঘর ছোট। একসাথে লাগানো না। মাঝে এক ফালি জায়গা। সেখানে কাঠ আর কিছু ইট জড়ো করা।  রান্না ঘরটা উঠোন পেড়িয়ে। ছোট ঘরটাতে থাকে সখিনা।

সেই রাতে দরজার সিটকানি টা দিতে যেয়ে সখিনা দেখল, ওটা ভাঙ্গা। কি করবে ভেবে, দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়লো। মাঝ রাতে ঘুমটা ভেঙ্গে গেলো। মনে হোল  ওর বুকের উপর কি যেন ঘুরে বেড়াচ্ছে। চিৎকার করতে যাওয়ার আগেই একটা হাত ওর মুখটা চেপে ধরল। তাকিয়ে দেখল ঐ লোকটা। অন্য হাতে ছুরি।

-একটা আওয়াজ করলে শেষ করে দেবো। তোকে আর তোর মাকে।

তারপর সখিনা আর কিছু জানেনা। শুধু জানে সেই রাতে ঐ পিশাচটা ওর সতীত্ব হরণ করেছিল। ঘরের এককোণে বসে কেঁদে ছিল অনেকক্ষণ।

সকালে পিশাচ টাকে কোথাও দেখতে পেলনা। মা  কে বলতে যেয়ে মনে হলও মা ওর কথা শুনতে চাচ্ছে না। সারা টা দিন না খেয়ে কাঁটালো।

তারপর এক সন্ধ্যায় কয়েকটা কাপড় নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল দৌলতপুর শহরের দিকে।

 মা কে বলেছিল, মা এখানে আমার থাকা হোল না। ঐ পিশাচ টাকে পাড়লে তুমি জবাই করো। মা ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, আমাকে তুই মাফ করে দিস।

 দৌলতপুরে ওর এক খালা থাকে। অনেকদিন আগে বাবার  সাথে গিয়েছিল সেখানে। অনেক কে জিজ্ঞাসা করে বাড়ীটা খুজে পেলো। প্রথমে খালা চিনতে পারেনি , পরিচয় দিতেই মুখটা গম্ভীর করে বলল, এসো।

-তা কতদিন থাকবে, বাছা।  বলে তাকালও ওর দিকে।

সখিনা বুঝতে পারলো এখানকার পাঠ খুব বেশি দিনের নয়।

আমতা আমতা করে বলেছিল, কোথাও একটা চাকরি পাই কিনা খুজে দেখবো। তারপর—

কথা শেষ হওয়ার আগেই খালা বেশ কর্কশ স্বরে বলেছিল, মাস খানেকের মধ্যে যদি কিছু পাও তোঁ ভাল, তার বেশি তোমাকে আমি রাখতে পারবো না বলে দিলাম।

সখিনা বুঝতে পাড়ল তার পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে। বার বার একটা কথাই মনে হচ্ছে, আত্মহত্যা। আত্মহত্যা করা ছাড়া তার আর কোন পথ নেই।

প্রতিদিন সকালে উঠে বেড়িয়ে পড়ে। এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করতে থাকে প্রতিটা দোকানে, প্রতিটা কল কারখানায়। চাকরি আছে কি?

কেউ আশ্বাস দেয়, কেউ সরাসরি না করে দেয়।

এমনি একদিন হাঁটছিল সে। পিছন থেকে একজন দ্রুত পায়ে এসে ওর কাঁধে আস্তে করে হাত রাখল।

চমকিয়ে পিছন ফিরে তাকাল। চিনতে পারলো না লোক টাকে।

কিছু বলতে যাওয়ার আগেই, খুব নরম স্বরে বলল, দুঃখিত। মাফ করে দেবেন। আপনাকে আমি গতকাল বশীরের দোকানে দেখেছিলাম। চাকরি খুজতে এসেছিলেন। আমার নাম খোকন, থাকি মাঠ পাড়ায়। যদি কিছু মনে না করেন তবে বলি,

এখান থেকে পঁচিশ মাইল দুরে জেলা শহর। ওখানে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারি।

সখিনা যেনও পায়ের নিচে মাটি দেখতে পেলো। ভাবল, পৃথিবীর সবাই খারাপ নয়। এখনো কিছু লোক আছে যারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।

-কি কাজ? উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো সখিনা।

-আমার এক মামি থাকে ওখানে, তাকে দেখাশুনা করতে হবে। প্রতিদানে অনেক টাকা দেবে। বলে হাসল সে।

এ যেনও হাতে চাঁদ পাওয়া। রাজি হয়ে গেলো সখিনা।

-কবে যেতে হবে?

-কালই রওয়ানা দেবো। বিকালে। ঐ বাস স্ট্যান্ডে এসে দাঁড়াবেন।

যেই কথা সেই কাজ। পরদিন রওয়ানা হয়ে গেলো দুজনে। পথের খাওয়া দাওয়ার পয়সা খোকন দিলো। অনেক গল্প করলো দুজনে।

পৌছাতে পৌছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। রিক্সা নিয়ে এলো এক গলির মাঝে। সখিনা তাকালও চারিদিক। কিছু কিছু লোক হাঁটছে। পানের পিক ফেলছে। সখিনার ভয় ভয় করছে।

রিক্সা দাঁড়ালো। ওরা নেমে এলো। খোকন মিটিয়ে দিলো ভাড়া।

দরজা খোলা।

-ও মামি, বলে ডাক দিলো খোকন।

দুই তিনটা মেয়ে একটু দুরে দাড়িয়ে। ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে। বেশভূষা যেন কি রকম, মনে হোল সখিনার।

মামি এলো। ঠোঁট পানের রসে রাঙানো।

-কিরে পেচু, নিয়ে এসেছিস।

-হাঁ বলে ফিক করে হাসল।

সখিনা বুঝতে পেরেছে কোথায় তাকে নিয়ে আসা হয়েছে। ঘৃনায় ঐ লোকটার মুখে থুথু মারতে ইচ্ছা করল।

মামি হাত ধরে টান দিলো।

-এসো এই ঘরে।

নতুন জীবন শুরু হোল সখিনার।  

সখিনা হোল চম্পা।

দশ টা বছর পাড় হয়ে গেছে চম্পার জীবন থেকে। কত লোক এলো, ভোগ করল।

মাঝে মাঝে ভাবে, মা কি বেচে আছে। ফিরে যাওয়ার পথ নাই। তরী ডুবে গেছে।

ফিরে এলো বাস্তবে। কাঞ্চনের দিকে তাকাল। হাতটা ধরে নিয়ে এলো ঘরের বাহিরে। ডাক দিলো মামি কে।

মামি বেড়িয়ে আসতেই বলল, ওর টাকা টা ফিরিয়ে দাও।

-মানে?  ফিরিয়ে দাও, বললেই ফিরিয়ে দেবো। ঘাড় ঘুরিয়ে বলল মামি।

-আবারও বলছি মামি, টাকাটা ফিরিয়ে দাও। ওর গলার স্বরে কি যেন ছিল। মামি আর ঘাটালও না। টাকাটা দিলো চম্পার হাতে।

কাঞ্চন মাথা নিচু করে তার ছায়া টা দেখছে। নিজের ছায়া টাকে সে চিনতে পারছে না। মনে হচ্ছে সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ছি ছি করছে। ওর মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে করছে।

ওর একটা হাত চম্পা ওর হাতের মধ্যে নিলো। অন্য হাত দিয়ে টাকা গুলো ওর পকেটে ঢুকিয়ে দিলো।

আস্তে আস্তে দরজার কাছে নিয়ে এসে হাত টা ছেড়ে দিলো চম্পা।

কাঞ্চন মাথা নিচু করে বেড়িয়ে গেলো।

You may also like

2 Comments

  1. অপূর্ব হয়েছে গল্পটা।বাস্তবএকটা গল্প।পৃথিবীতে কত মেয়ে এভাবেই শেষ হয়ে যায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *