নভেম্বেরের মাঝা মাঝি। ঠাণ্ডা ততটা প্রকোপ নয়। তাপমাত্রা ৫০ এর কোঠায়। তবুও গায়ে, মাথায় গরম বস্ত্র থাকা ভালো। সেই ভাবে প্রস্তুত হয়েই বেড়িয়ে ছিলাম বাহিরে। যেতে হবে বোস্টন। বন্ধু নামিয়ে দেবে Port authority Bus terminal এ। রাতের বাসে যাবো। বন্ধু যথা সময়ে নামিয়ে দিলো আমাকে, আমার সময় অনুসারে নয়, তার সময় অনুসারে। গরজ আমার, তার নয়। কাজেই পোঁছে গেলাম দু ঘণ্টারও বেশী সময় হাতে নিয়ে। এমতো অবস্থ্যায় করনীয় কিছু নাই, শুধু কফি পান করা ছাড়া। ঘড়িতে দেখলাম দুঘণ্টা সময় আছে বাস ছাড়তে। অগত্যা পাশের স্টারবাক্স থেকে কফি নিয়ে একটা খালি বেঞ্চে বসলাম। গরম কফিতে ঠাণ্ডা কিছু টা কাটবে।
কফিতে চুমুক দেবার আগেই Hi শুনে তাকালাম সামনে দাঁড়ানো মেয়েটার দিকে। Hi এর পরিবর্তে Hi বলতে হবে এটাই প্রচলিত নিয়ম। বললাম, Hi. এক ঝলক দেখে মনে হোল বয়স ষোলো থেকে আঠারোর কোঠায়। Blond hair, অরিজিনাল হয়তো হবেনা, রং করা। গাড়ো লাল লিপিস্টিকের প্রলেপ ঠোঁটে, মুখে রং এর ব্যাবহার একটু বেশী বলে মনে হোল, স্কিন টাইট প্যান্ট, বুঝতে বাকী রইল না সে কোন পেশায়ে নিয়োজিত। “ এক কাপ কফি খেতে ইচ্ছা করছে”। বুঝলাম সে পয়সা চায়। লিংকনের ছবি ওলা নোট টা দিয়ে বললাম, “ এটা কফির জন্য, চেঞ্জ ফেরত দিতে হবেনা “। এটা আমার ভদ্রতা নয়, তাড়াতাড়ি ওকে বিদায় করাই আমার উদ্দেশ্য। মাথায় ঘুরছে শতশত চিন্তা। কাছা কাছি নিশ্চয় ওর পীম্প আছে, যে কিনা নজর রাখছে। এই বাস ডেঁপো টা আমার প্রিয় জাগা নয়। তাও এত রাতে।
“ বসতে পারি ?” খুব ভদ্র ভাবে বলল সে। হাতে কফির কাপ। “ তোমার দেওয়া বাদবাকি ডলার দিয়ে কেক টাও কিনে নিলাম। খিদে পেয়েছে”। এই বেঞ্চ আমার সম্পতি নয়, কাজেই বসতে না বলার অধিকার আমার নেই। সে পাশে বসল। কি নাম তোমার? “জুলীয়া”। কতদিন আছো এই বাপ্সায়ে ? “ বছর খানেক হোল”। বয়স কত? উনিশ পেড়োল। চারিদিক তাকিয়ে দেখলাম কেউ এগিয়ে আসছে কিনা। কালেঙ্কারীতে জরা তে রাজী নই। উঠে অন্য খানে যেয়ে বসবো ভাবলাম। কিন্তু কি একটা মোহ আমাকে যেতে দিলোনা। জানতে ইচ্ছা করলো, এই বয়সে কেন এ পথে।
“ এখানে বসে থাকলে তোমার ব্যাবসায়ে ক্ষতি ছাড়া লাভ হবেনা, তাই নয় কি” ?। বলল, “ আজ বাজার মন্দা। তাইতো তোমার কাছ থেকে পয়সা চেয়ে খেতে হোল। আজ আর নয়।” এপথে কেন?
সে অনেক বড় কাহিনী। ঘড়িতে দেখলাম এখনো অনেক দেরী বাস আসতে। বললাম আপত্তি না থাকলে বলতে পারো।
বাসা আমার ক্যানসাস এর এক ছোট্ট শহরে। দুবোন, বোন আমার পাঁচ বছরের বড়। বাবা আর মা। বাবা auto mechanic আর মা এক দোকানে স্বল্প সময়ের জন্য কাজ করে। কোনদিন দুজনের মধ্যে মিল আমি দেখিনি। বাবা বেশীর ভাগ সময় মাতাল হয়ে বাসায় ফিরতো। যাকে বলে আল্কহলিক। সংসারে মানসিক অশান্তির সাথে সাথে টাকা পয়সার টানা টানি লাগেই ছিল। বাবার ইনকাম মদেই উড়ে যেতো।
কোনদিন ভালো জামা কাপড় পড়েছি বলে মনে পড়েনা। ফলে বন্ধু বান্ধবী দের সাথে কোথাও যেতে অস্বস্তি বোধ করতাম। বাসাতে আনার মত অবস্তাও ছিল না। বয় ফ্রেন্ড জোগাড় করতে পারিনি হয়তো inferiority complexএ ভুগতাম সেইজন্য। মা বাবার মধ্যে কোলাহল লাগেই ছিল। একদিন তা চরমে উঠল। মদে বুদ হয়ে এসে মার গায়ে হাত তুললো বাবা। অকথ্য ভাসায় গালাগালি করতে থাকলো কোন কারণ ছাড়াই। মা ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো। বাবাকে দিড়রো ভাসায় বললাম বাসা থেকে বেড়িয়ে যেতে। সে চলে গেলো টলতে টলতে। বেশে কিছুদিন তার কোন দেখা পায়নি। এর মধ্যে আমার বড় বোন তার বয় ফ্রেন্ড নিয়ে বাসা ছেড়ে চলে গেলো। লিখে রেখে গেলো,” এই নরকে আমি থাকতে রাজী নই”। সংসারে টানাটানি। ঈস্কুলের শেষ বর্ষের ছাত্রী আমি। পারট টাইম কাজ নিলাম এক Bar এ। কোন রকমে টিকে থাকার জন্য। চার পাঁচ দিন বাদে বাবা এসে হাজির হলো। মা কিছু বলল না। শেষ নিঃস্বাস তার এই বাসাতে ত্যাগ করতে হবে বলেই হয়তো বিধাতা তাকে পাঠিয়ে দিয়ে ছিল। সেই রাতে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেলো বাবা। সে চলে যাওয়াতে আমি যে দুঃখিত হয়েছিলাম তা নয়। বরং ভাবেছিলাম এখন আমরা, মা আর আমি মিলে অভাব অনটন কিছু টা কাটিয়ে, সুন্দর পরীচছন্ন জীবন অতি বাহিত করতে পারব। কিন্তু বিধি বাম। এক রাতে নির্ধারিত সময়ের আগেই কাজ থেকে চলে এসেছিলাম। কেলাসের কিছু assignment বাকী ছিল। না আসলেই বোধ হয় ভালো হতো। দরজা খুলতেই পুরুষের গলা শুনলাম মার ঘর থেকে। ইচ্ছা করেই দরজাটা জোড়ে বন্ধ করলাম। মার ঘরের দরজাটা খুলে গেলো। মা বেড়িয়ে এলো আর একজনের সাথে, আলু থালু বেস। পরিচয় করিয়ে দিলো, “কেভীন”।
তার চোখের চাউনী আমার ভালো লাগল না। আমি আমার ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলাম। পেড়িয়ে গেলো বেশ কিছুদিন। কোন এক week end এ মা কে কাজে যেতে হয়েছিল। বাসাতে আমি একা। পরীক্ষা সামনে। বাস্ত আমি। ঘরের দরজাতে টোকা পড়ল। ভাবলাম মা এসেছে বোধহয়। খুলতেই দেখি কেভীন মার কাছে এসেছে। বললাম মা নেই। শুনল না। ঘরে ঢুকে পড়ল। হায়েনার দাঁতের মত হলদে দাঁত গুলো বেড়িয়ে এলো। হাসছে। এগিয়ে আসছে। আমার সারা শরীর থর থর করে কাঁপছে। বিধি সেদিন আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। মা ঢুকলো ঘরে। কেভীন তার হলদে দাঁত বের করে মা কে জড়িয়ে ধরল। ঘ্রীনায় সারা শরীর আমার রি রি করছে। বাড়ী থেকে বেড়িয়ে গেলাম। জানি মা কে বলে কোন লাভ নেই। ঠিক করলাম পরীক্ষা শেষে বেড়িয়ে পড়বো বাড়ী থেকে।
বেড়িয়ে পরেছিলাম এক রাতে সব স্রীতী পিছনে রেখে নতুন জীবনের আসায়। এই বাস টার্মিনালএ এসে পোঁছেছিলাম রাত একটায়। এক বান্ধবীর টেলিফোন নাম্বার ছিল সাথে। ফোন করলাম। উত্তর নেই। না জানা শহর। ভয় যে হয়নি তা নয়। এই বেঞ্চ টাতেই শুয়ে ছিলাম সেই রাতে। ভোরের আলো উঠতেই ফোন করলাম। হ্যালো বলতেই নাম বললাম। চিনলো। ঠিকানা দিলো। পোঁছিয়ে দেখলাম ছোট্ট একটা রুম। আগোছাল। বলল এখানে থাকো, কোন একটা কিছু হয়ে যাবে। রাতে সে বেড়িয়ে যায়। কি করে জিজ্ঞাসা করিনি। একদিন বলল,” চলো, পরিচয় করিয়ে দেই একজনের সাথে, ভালো ছেলে।”
পরিচয় হোল। নাম রিকি। চোওকশ, অতি ভদ্র। বললাম,” চাকরি চাই।” বলল, “ হবে, ধরজো ধর”।
ভালো লাগলো রিকি কে। পোশাক আসাকে মনে হয় ভালো কাজ করে। একদিন প্রস্তাব দিলো তার সাথে রুমমেট হয়ে থাকার জন্য। অখুশি হলাম না। ওর মাঝে আছে একটা আকর্ষণ যা আমাকে বার বার টেনে নিয়ে গেছে ওর কাছে। রাজী হলাম। চলে এলাম ওর এপার্টমেন্টএ। সুন্দর গোছানো সব কিছু। ভাবলাম বিধাতা এতদিনে মুখ তুলে চেয়েছে। কিন্তু আলোর পিছনে যে অন্ধকার থাকে তা ভুলে গিয়ে ছিলাম।
এক রাতে আমি একা। দরজায় ঠোকা পড়ল। ভাবলাম রিকি এসেছে। খুলতেই দেখি দুজন লোক। কোন কিছু বলার আগেই ডুকে পড়ল। একজন দরজা টা বন্ধ করে দিলো। এর পরের ঘটনা তোমাকে ব্যাখ্যা করার দরকার নেই। সব শেষে যাওয়ার আগে ওরা বলে গেলো, রিকি কে টাকা দিয়েছি, ওখান থেকে তোমার পাওনা নিয়ে নিও”। সেই শুরু। ভদ্র মুখোসের নিচে যে হায়েনার হিংস্রতা থাকে বুঝিনি আগে। রিকিই আমার পিম্প। এর থেকে মুক্তি কবে পাবো জানি না। তোমকে সব কথা বলে বুক টা একটু হাল্কা হোল।
এই পর্যন্ত বলে সে থেমে ছিল। বললাম,” বড়ো বড়ো উপদেশ দিয়ে সময় নষ্ট করবো না। তবে এই বলি রাতের ব্যাবসার সাথে সাথে দিনে কলেজে যেয়ে কোন কোর্স করতে পারো কি না দেখো। হয়তো কাজে লাগবে কোনদিন।
আমার বাস এসে গেছে। বললাম, “ চলি”। তার চোখে কোন জলের আভা আমি দেখিনি। সে চলে গেলো তার গন্তব্য স্থানের দিকে। আমি উঠে পড়লাম বাসে।
সময় পেড়িয়ে গেলো। আমি বাস্ত হয়ে রইলাম আমার কাজ নিয়ে। কখন যে চার বছর পেড়িয়ে গেছে মনে নেই। কোন এক কাঁক ডাকা সকালে ফোন পেলাম আমার এক বন্ধুর। থাকে পার্ক স্লোপে। বলল,” চলে এসো দুপুরে, আড্ডা দেওয়া যাবে, আরও কজন কে বলেছি”। না করলাম না। যথা সময়ে এসে পোঁছালাম। গাড়ী টা পার্ক করে বের হতেই হ্যালো শুনে সামনে তাকালাম। একটা couple এগিয়ে আসছে। আশে পাশে কাউকে দেখলাম না। কাজেই হ্যালো টা আমাকে উদ্দেশ্য করেই। সামনে এসে দাঁড়ালো। কালো চুল কাঁধ পর্যন্ত এলিয়ে পরেছে। ঠোটে হাল্কা করে আঁকা রং এর প্রলাপ মুখের রং এর সাথে মিলিয়ে। গায়ে J-Crewর জামা। কিছু বলার আগেই উচ্ছোসিত হয়ে জড়িয়ে ধরে দুগালে চুমু দিয়ে বলল,” অনেক খুঁজেছি তোমাকে। কত বার যে অয়ী বেঞ্চটাতে বসে কাটিয়েছে আর ভেবেছি হয়তবা একদিন তুমি এই পথ দিয়ে যাবে, সেই আশায়। তোমের দেওয়া টেলিফোনে ফোন করেছি, রং নাম্বার, হয়তো লিখতে ভুল করেছিলাম”। এত গুলো কোথা বলে সে থামল। রং নাম্বার ছিলোনা, আমিই রং নাম্বার দিয়েছিলাম পাঁছে কোন কিছুতে জড়িয়ে পড়ি। সাহসিকতার পরিচয় সেদিন আমি দিতে পারিনি।
বললও “ তোমার দেওয়া উপদেশ আমি পালন করেছিলাম। কমুনিটি কলেজ থেকে কোর্স করে আজ আমি ইলিমেনটারি স্কুলের শিক্ষক। পিছনে ফেলে এসেছি আমার অতীত। Sorry, পরিচয় করিয়ে দেই, আমার ফীয়ান্সে। অ্যালেক্স। আসছে মাসে আমাদের বিয়ে। আসবে তো? তোমার ঠিকানা আর ফোন নাম্বার টা দাও”।
এবার ঠিক মতই সব দিলাম। বললাম আসবো। আবারও দুগালে চুমু দিয়ে বললও,” আসি, তুমি আমার দেবতা।” দুজনে হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে মিলিয়ে গেলো লোকের ভিড়ে। আমি শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম। চোখের কোণটা মুছে আমিও এগিয়ে গেলাম আমার গন্তব্য স্থানের দিকে।