পরী

       শমশের আলী ছিল ছেলেদের হাই স্কুলের হেডমাস্টার। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে সেই আমলে বিএ পাশ করে এই মফস্বল শহরে এসে আস্তানা গেরে ছিল।

তার পিছনে অবশ্য ইতিহাস আছে। লেখা পড়ায় ভালো শমশের আলী ছিল উচ্চাভিলাষী। কলেজের প্রফেসরদের নজরেও পড়েছিল। মাস্টার্স শেষ করে দেশের বাহিরে যাওয়ার পরিকল্পনা যে ছিল না তা নয়। তবে মন চেয়ে ছিল একদিন এই কলেজের প্রফেসর হবে। কিন্তু বিঁধি বাম।

মাস্টার্সে আর ঢোকা হলনা। খবর এলো বাবা হঠাৎ করে মারা গেছে। তল্পিতল্পা ঘুচিয়ে রওয়ানা দিলো দেশের দিকে।

বাড়ীর বড় ছেলে সে। হাল তো তাকেই ধরতে হবে।

বাড়ীতে আছে মা, আর ছোট বোন।

মাধবপুর গ্রাম। আছে ধান ক্ষেত, আছে বিল। চারিদিকে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ।  ছিমছাম একটা গ্রাম। শমশের আলীর বাবার ছিল কয়েক বিঘা ধানিজমি, ছিল বড় একটা পুকুর।  জীবন ছিল সচ্ছল।

শমশের আলী যখন বাসায় এসে পৌছাল তখন সন্ধ্যা হয় হয়। ছেলেকে দেখে মা আবারও কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। বোনটা এসে জড়িয়ে ধরলও ভাইকে। রহমান চাচা এসে শমশের আলীর মাথায় হাত রাখল।  

-হাত মুখ ধুয়ে নাও, আমি তোমার খাওয়ার ব্যবস্থা করছি। বলে আয়েশা চাচী উঠে গেলো রান্না ঘরের দিকে।

-আমি বাবার কবর দেখতে যাবো চাচী। বলে শমশের আলী বারান্দা থেকে নিচে নেমে এলো।

বাসার কাছেই কবরস্থান। রহমান চাচার হাতে হ্যারিকেন। চারিদিকে অন্ধকার। শুধু হারিকেনের আলোতে পায়ে হাটা পথ ধরে ওরা এলো কবরস্থানে। এতক্ষণ কাঁদেনি শমশের আলী। বাবার কবরের ভিটিতে হাত রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো সে।

বাবাই ছিল তার সব চেয়ে কাছের মানুষ।

মনে পরে, বাবা তার শেষ চিঠিতে লেখেছিল, তুই অনেক বড় হবি শমশের।  আমি সবসময় তোর জন্য দোয়া করি।

-চলো বাবা, রাত হোল। পিঠে হাত রাখল রহমান চাচা।

রহমান চাচা শমশেরের বাবার চাচাতো ভাই। বয়সে শমশেরের বাবার চেয়ে অনেক ছোট। শমশেরের বাবার এইকুলে আর কেউ নাই। এই চাচাতো ভাইয়ের সাথেই তার উঠা বসা ছিল। দুজনে মিলেই নিজেদের জমিজমা দেখা শুনা করতো।

বেশ কটা দিন গ্রামের চারিদিকে ঘুরে বেড়িয়ে আর মা কে সংগ দিয়ে কাটিয়ে দিল শমশের আলী। ভাবল, বাহিরে কোথাও যেয়ে একটা চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু তাই না বোনটা ক্লাস এইটে। আর কদিন পরে স্কুল শেষ করে কলেজে যাবে। ওর ও একটা ভালো স্কুলে যাওয়ার দরকার।

মা কে বলেছিল। প্রথমে মা রাজি হয়নি। পরে বলেছিল, তুই যা ভাল মনে করিস তাই কর।

একদিন চাচা কে বলেছিল তার পরিকল্পনার কথা। শুনতেই চাচা বলেছিল মহেশখালীর হাই স্কুলের কথা।

-তুই কালই চলে যা, ওইখানে যেয়ে খোঁজ নে। শুনেছি ওদের হেডমাস্টার চলে গেছে নতুন চাকরি নিয়ে। তোর তো বিএ ডিগ্রী আছে। তাও আবার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে, তোকে ওরা নিয়ে নেবে।

চাচার কথা শুনে পরের দিনই রওয়ানা দিয়েছিল শমশের আলী।

দেখা করেছিল স্কুলের কমিটির লোকদের সাথে।

চাকরিটা হয়ে গেলো।

চাচার উপর জমিজমার ভার দিয়ে শমশের আলী মহেশখালীতে এসে বাসা বাধল।

আসার সময় চাচা বলেছিল, খুব তো একটা দুরে নয়, মাঝে মধ্যে এসে দেখে যাস। চিন্তা করিস না। তোদের সব কিছু আমি দেখে রাখবো। বড় ভাই ছিল আমার বট গাছ। সে আমাকে আগলিয়ে রেখেছে সব সময়। সে কি আমি  ভুলতে পারি।

কথা শেষে অনেক কেঁদে ছিল চাচা।

আস্তে আস্তে অনেক গুলো বছর পেড়িয়ে গেলো। এই ছোট্ট শহর টিকে শমশের আলী ভালোবেসে ফেলল। রাস্তায় চলতে গেলে লোকে এসে সালাম দেয়।

-হেড মাস্টার মশায় কেমন আছেন? বলে কুশল সংবাদ নেয়।

ভালো লাগে শমশের আলীর।

একদিন ভাড়া বাড়ি ছেড়ে আম, কাঁটাল বাগানে ভরা নিজের বাড়ীতে উঠে ছিল শমশের।  ছোট বোনটারও একদিন বিয়ে হয়ে  গেলো।

বাসাতে শুধু মা, আর সে।

মা বলে, শমশের এবার একটা বৌ নিয়ে আয়, বাবা। আমি আজ আছি কাল নেই। তোকে বৌ এর হাতে তুলে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত মনে ডাক আসলে যেনও যেতে পারি।

সেই দিনও এলো। স্কুলের এক শিক্ষকের বোন কে নিয়ে এলো বৌ করে। মা খুব পছন্দ করলো বৌমা কে।

বৌমার হাতে সংসার টা উঠিয়ে দিয়ে  সেও পাড়ি দিলো ওপারে।

বৌ নিয়ে মাধবপুরে এসেছিল শমশের। মা র আগেই চাচা চলে গেছে। চাচাতো ভাইরা সব দেখাশুনা করে।

জসীম বলেছিল, চল ভাবী তোমাকে তোমাদের জমি গুলো দেখাই।

আমেনা দেখে চোখ বড় বড় করে বলেছিল, এত অনেক জমি জসীম ভাই।

-অনেক তো বটেই। আর এই পুকুর টাও তোমাদের। এখানে বিভিন্ন মাছের পোনা ছাড়ি প্রতি মাসে। 

যাবার সময় জসীম বলেছিল, ভাবী, এখান থেকে ধান, তরিতরকারি, মাছ পাঠাবো তোমার ওখানে। তুমি ধান আর চাল রাখার গুদামের ব্যবস্থা কর।

মাঝে মাঝে জসীম নিজে নিয়ে আসতো। অথবা অন্য কারো দিয়ে পাঠিয়ে দিতো।

শমশের আলীর সংসার বড় হোল। ঘরে এলো দুই মেয়ে এক ছেলে। ছেলে মেয়েদের নিয়ে সন্ধ্যায় মাদুর পেতে বারান্দায় বসতো শমশের আলী। আমেনা বেগম  রান্না ঘরের কাজ সেরে ডাক দিতো খাবার জন্য। শমশের আলী ভালো ভালো মাংসের টুকরা, মাছের পেটী উঠিয়ে দিতো ছেলে মেয়েদের পাতে।  

-তুমি সারাদিন কাজ করে আসো, ওই গুলো না খেয়ে ওদের পাতে উঠিয়ে দিচ্ছ? বলে গজ গজ করতো আমেনা।

শমশের আলী শুধু হাসত।

বাবার নেওটা ছিল ছেলে মেয়েরা। বাবা বাসায় এলেই নালিশ দিতো বাবার কাছে। কতবার মা ওদেরকে বকা দিয়েছে, কতবার মা পড়ার সময় হ্যারিকেন নিয়ে গেছে।

স্কুলের হেড মাস্টারির সাথা সাথে কিছু ব্যবসা আরম্ভ করেছিল শমশের আলী। কাঠ কাঁটার কল বসিয়েছিল বাসার সামনের জমিতে। সেই সময় পাঁটের ব্যবসা রমরম। শমশের আলী এক বন্ধুর সাথে পাঁটের ব্যবসা আরম্ভ করল। কাট আর পাঁটের ব্যবসা মন্দ চলছিল না।

দুই মেয়ের বেশ ধুমধাম করেই বিয়ে দিয়েছিল শমশের আলী। মেয়ে দুটো চলে যাওয়াতে বাসা টা বড় নীরব হয়ে গেল।

একদিন শমশের আলীই আমেনা কে বলল, তোমার ছেলের এবার একটা বিয়ের ব্যবস্থা করলে কেমন হয়? লেখা পড়া যা করেছে তাতে বাহিরে যেয়ে চাকরি না খুজে এই ব্যবসা গুলো দেখাশুনা করুক। বাসাতেও একটা বৌ আসুক। তোমারও ভালো লাগবে। কথা বলার একটা সঙ্গী পাবে। কি বলও?

-আপনি যা ভালো মনে করেন তাই করেন। জামসেদ কে বলে দেখেন, রাজি আছে কিনা।

– তুমি আজ রাতেই ওকে ডেকে এনে কথা টা পাড়। নবহাটির সবুর মিয়াঁর বড় মেয়ে টার কথা সেদিন আজমল বলছিল। আজমল কে তো চেনও? আমার স্কুলের অংকের মাস্টার। বলেছিল দেখতে শুনতে ভালো। কথা গুলো বলে শমশের আলী উঠানে নেমে এলো। যাবে মসজিদে। নামাজ পড়ার সাথে সাথে লোকজনের সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হয়। ভালো লাগে।

সেই রাতেই আমেনা জামসেদ কে বলেছিল কথা টা। জামসেদ অরাজী হয়নি।  

দিনকাল দেখে পরী কে ঘরে নিয়ে এলো বৌ করে।  পরী ঠিক পরীর মতই দেখতে। গায়ের রং দুধে আলতা মেশানো। গ্রামের মেয়ে। লেখা পড়া ততটা করে নি। কিন্তু আদব, আচরণ দেখে শমশের আলী আর আমিনা দুজনেই খুব খুশি।

ভোরে ঘুম থেকে উঠেই সোজা চলে যায় রান্না ঘরে। শ্বশুর বাবা আর শাশুড়ি মার জন্য নাস্তার ব্যবস্থা করতে।

পরী নিজের হাতে ভার নিলো সব কিছুর। কাউকে বলে দিতে হোল না কি করতে হবে।

 আগে বাসার কাজের মেয়ে টা এসে রান্না ঘর খুলত। নাস্তার ব্যবস্থা করতে করতে নয়টা বেজে যেতো। আমিনা ঘুম থেকে উঠত একটু দেরী করে। কাজের মেয়ে টাকে বলে দিতো আজ কি কি রান্না করবে।

এখন শমশের আলী গরম ভাত খেয়ে স্কুলে যায়। জুতো জোড়া ঠিক জাগায় পায়। আগে খুজতে হতো।

শেফালীর মা, পাশের বাসার, প্রায় প্রতিদিন বিকেলে আসে। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। আমেনা বেগম বসে ছিল বারান্দায়। পাশে রাখা বেতের টুল টা এগিয়ে দিল। শেফালীর মার হাতে পানের ডিব্বা। টুলে বসে দুটো পান বানাল শেফালীর মা।

একটা পান আমেনা বেগমের দিকে এগিয়ে দিল।  

পরী রান্না ঘরে রাতের খাবার কি কি করবে তার ব্যবস্থা করছিল। কাজের মেয়ে, রহীমা, ওকে সাহায্য করছিল।

রান্না ঘর থেকে উকি মেরে দেখল পরী। উঠে এলো ওদের কাছে।

-খালা চা দেবো? বলে তাকালও শেফালীর মার দিকে।

-না, মা, পান খাচ্ছি, চা খাবো না। বলে হাসল শেফালীর মা।

পরী চলে যেতেই বলল, তুমি ভাগ্যবান, ভালো একটা বৌ পেয়েছ।

-সবই আল্লার ইচ্ছা। বাসাটা একটু খালিখালি লাগে, একটা নাতি, নাতনী আসে গেলে হৈ চৈ করতাম ওটাকে নিয়ে।

শেফালীর মা কি যেন বলতে যাচ্ছিল, সদর দরজা খোলার শব্দে তাকালও সেদিকে। শমশের আলী কে দেখে বলল, আজ আসি বইন। কাল আসব। বলে উঠে পড়লো।

হাত, মুখ ধুয়ে শমশের আলী এসে বসলো বারান্দায় পাতা চেয়ার টাতে। মুখ গম্ভীর।

শ্বশুর কে দেখে রান্না ঘর থেকে উঠে এলো পরী। হাতে এক জোড়া স্যান্ডেল।

-এই স্যান্ডেল টা পড়েন বাবা, ওটা ছেড়া। চা বানিয়েছি, সাথে মুড়ি দিচ্ছি। বলে। পরে থাকা স্যান্ডেল টা উঠিয়ে নিলো।

-ঠিক আছে মা। বলে টেবিল থেকে কাগছ কলম  হাতে নিলো শমশের আলী। কি যেন হিসাব করল।

আমেনা বেগম পাশে এসে দাড়াতেই, শমশের আলী বলল, জামসেদের মা, পাঁটের দাম টা পড়ে গেছে। অনেক টাকা লোকসান হয়ে গেলো।

-ও নিয়ে ভাববেন না। আল্লা সহায়।

-ভাবতে চাই না, কিন্তু মাথায় চলে আসে। অনেক টাকা লোন রয়েছে। শমশের আলী আবারও কাগছের মধ্যে কি কি যেন লিখল। টাকা পয়সা নিয়ে আমেনা বেগম কোন সময়ই মাথা ঘামায় নি। বরং শমশের আলীই বলত জামসেদের মা, কোথায় কি আছে তোমাকে বুঝিয়ে দেই।

আমেনা বেগম বলেছিল, আপনার ছেলে কে বলেন, সেই বুঝে নেবে।

-ও বড়ই ছেলে মানুষ, বুঝে টুঝে চালাতে পারবে বলে মনে হয় না।  

কথা বলার মাঝে পরী চা আর মুড়ি রেখে গেলো টেবিলের উপর।

পরী চলে গেলে শমশের আলী তাকাল আমেনা বেগমের দিকে। বলল, ভবিষ্যৎ তে ওই বৌ ই তোমাকে দেখাশুনা করবে। মেয়েরা তো সবই বাহিরে চলে গেলো।

গম্ভীর প্রকৃতির শমশের আলী আরও গম্ভীর হয়ে গেলো। কথা বার্তা বলা কমিয়ে দিলো। মাঝে মাঝে উঠানে পায়চারি করে আর কি যেন ভাবে। আমেনা বেগম জিজ্ঞাসা করেছিল একদিন, শারীরিক কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা। শমশের আলী নেতি সুচক উত্তর দিয়েছিল।

আমগাছে মুকুল এসেছে। প্রতি বছর এই সময় টাতে আমেনা বেগম যায় তার বাপের বাড়ি। শমশের আলী তা জানে।

একদিন গাড়ীর ব্যবস্থা করে দিয়ে বলেছিল, চিন্তা করো না বৌমা আছে, সে  সব দেখেশুনে রাখবে।

দুইদিন না যেতেই খবর এলো শমশের আলী হৃদপিন্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছে। মাথায় বাজ ভেঙে পড়ল আমেনা বেগমের।

বাসায় এসে দেখে অনেক এসেছে। এসেছে স্কুলের মাস্টার, ছাত্ররা। এসেছে আত্মীয় স্বজন। কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল হয়ে  গেছে আমেনা বেগমের। পরী আর জামসেদ এসে পাশে দাঁড়ালো।

কিছুদিন পাড় হয়ে গেছে। পরী ধরেছে হাল। শাশুড়ির সেবা, স্বামীর ভালোমন্দ দেখা, সেই সাথে উননের কাজ, সব এক হাতে করতে থাকল। গ্রাম থেকে নিয়ে এলো এক মেয়ে, নাম আয়েশা। ওকে সাহায্য করার জন্য। স্বামীকে বাসায় রেখে গেলো শ্বশুরের ভিটায়।

কোথায় কোন জমি আছে, কোন জমিতে কি চাষ হয় সব কিছুর একটা হিসেব নিয়ে এলো। চাচার ছেলে বাদল, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছিল সবকিছু।

 আমেনা বেগম কে সমস্যার কথা ভাবতে হয়নি । মনে পড়েছিল স্বামী বলেছিল, এই বৌমাই একদিন তোমার দেখাশুনা করবে। তাই হোল।  

দুই মেয়ে এসে কিছুদিন থেকে চলে গেলো নিজ নিজ সংসারে।

দিন পেড়িয়ে মাস, মাস পেড়িয়ে বছর। পরীর কোলে এলো এক ছেলে। দাদির সাথে খেলা করে। পরী ব্যস্থ থাকে ঘরের কাজ নিয়ে।

হঠাৎ একদিন সিঁড়ি দিয়ে নামতে যেয়ে, আমেনা বেগম পড়ে গেলো মাটিতে। পরী ছিল  পিছনের বাগানে। শাকসবজি তুলছিল। আয়েশা দৌড়ে এসে খবর দিলো।

আমেনা বেগম তখনও মাটিতে পড়ে। উঠার চেষ্টা করেছিল কিন্তু পাড়ল না। পরী আয়েশা কে পাঠালও জামসেদ কে খবর দেওয়ার জন্য।

জামসেদ এসে মা কে উঠিয়ে চেয়ারে বসাতেই আমেনা বেগম চিৎকার করে উঠল। বিছানায় শোয়ায়ে দিয়ে জামসেদ গেলো ডাক্তার আনতে।

পরী গরম তেল এনে মালিশ করতে থাকলো, যদি ব্যাথা কমে।

-আমার কি হবে ,মা, আমি হাটতে পারবো তো। বলে কাঁদতে থাকলো আমেনা বেগম।

-এখনি ডাক্তার আসবে। সব ঠিক হয়ে যাবে, মা। চিন্তা করবেন না। পরী সান্ত্বনা দেয়।

ডাক্তার পরীক্ষা করে বলল, একটা এক্সরে করা দরকার। হাসপাতালে নিয়ে যান। ওখানে ওরা সব ব্যবস্থা করবে।

গাড়ী ডাকা হোল। আমেনা বেগম কে হাসপাতালে ভর্তি করা হোল।

এক্সরের রিপোর্ট এলো। মাজার হাড্ডি ভেঙে গেছে। অপারেশন করতে হবে। যেতে হবে শহরে। অথবা রাজধানীতে।

আমেনা বেগম অপারেশন করতে রাজি হোল না। ফিরে এলো বাসাতে। সময় বয়ে গেলো। আস্তে আস্তে ব্যথা কমে এলো।

কিন্তু আমেনা বেগম আর বিছানা থেকে উঠতে পাড়ল না।

পরী একটা মেয়ে কে নিয়ে এলো গ্রাম থেকে। শাশুড়ি কে দেখাশুনা করার জন্য।

পরী হাতের কাজ শেষ করে শাশুড়ির পাশে এসে বসে, বই পড়ে শুনায়। কে কেমন আছে তার খবরাখবর দেয়।

প্রতিদিন শাশুড়ির বিছানা পত্র পরিষ্কার করে।

একদিন শাশুড়ির চোখে জল দেখে পরী জিজ্ঞাসা করেছিল, আপনি কাঁদছেন কেন মা? আমি কি আপনের সেবা করতে পারছি না? কোন ভুল ত্রুটি হচ্ছে?

-মা, খোদাতালা তোমাকে না এনে দিলে আমি কবেই চলে যেতাম। বলে কাঁদতে থাকলো আমেনা বেগম।

পরী শাশুড়ির চোখটা মুছিয়ে দিয়ে বলেছিল, আপনার মতো মা পাওয়া ভাগ্যির কথা। আমাকে দোয়া করবেন সারা জীবন যেন আপনার সেবা করে যেতে পারি।  

আজ অনেক অনেক বছর হয়ে গেলো। আমেনা বেগম বিছানায় পড়ে আছে।

পরীর বয়স বেড়েছে। কিন্তু কাজের অন্ত নেই।

ঘরের কাজ, স্বামীকে দেখা, সেই সাথে শাশুড়ির প্রতি রাতের নোংরা কাপড় বদলিয়ে নতুন কাপড় পড়িয়ে দেওয়া। সবই হাসি মুখে করে যাচ্ছে সে।

যেন এই ভাবেই করে যেতে পারে এই মোনাজাত করে সে ঘরের এলো নিভিয়ে দেয়, ভোরের আলোর সন্ধানে। 

 

You may also like

3 Comments

  1. সুন্দর গল্প।পরিচিত কারো জীবনের প্রতিচ্ছবি।খুব ভালো লাগলো।

  2. পড়ে খুব ভাল লাগল।আরও লেখা পাবার আশা করচ্ছি।

  3. পড়ে খুব ভাল লাগল।আরও লেখা পাবার আশা করচ্ছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *