দুই রুম নিয়ে মহিদের বাস। ছোট্ট এক চাতলা রান্না ঘর। ওটাকেই গুছিয়ে নিয়েছে। একপাশে রেখেছে কফির মেশিন। ষ্টোভের পাশে রেখেছে পুরানো একটা টোস্টার-ওভেন। ঘরটার এককোনে দেয়ালে লাগানো স্থায়ী খাওয়ার টেবিল। এরই মাঝে আছে ডিশওয়াসার। বলতে গেলে বেশ ছিমছাম।
রান্না ঘর থেকে বের হলেই এল শেপের বসার ঘরের সাথে ফর্মাল ডাইনিং টেবিল। দুটো সোফা, সামনে একটা টেলিভিশন।
এই হচ্ছে মহিদের জগত। ভাড়া নিয়েছে এক পরিচিতার কাছ থেকে।
এমন ছিলনা আগে। ছিল বড় বাড়ী। অনেকে আসতো। হই হুল্ল করত। আজ আর কেউ আসেনা। মাঝে মধ্যে কল করে।
আজ, সকাল থেকেই আকাশ গোমড়া করে আছে। ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। বৃষ্টি আসবে। বাহিরে হাটতে যাওয়া হোল না মহিদের। ভাবল তামান্নাকে কল করলে মন্দ হয় না। আগে অনেক কথা হতো। তামান্না কল করতো।
ইদানিং আর করে না। একটা বিষণ্ণতা মহিদ কে পেয়ে বসেছে আজ। কারো সাথে কথা বলে হাল্কা হতে চায়।
তামান্না ধরলও ফোনটা। জিজ্ঞাসা করল, কেন সে ফোন করেছে।
মহিদ বলল, এমনি, কেমন আছো, ব্যাস্ত কিনা।
মহিদের মনে হোল, তামান্নার কথার তাল কেটে যাচ্ছে। অন্যমনস্ক।
তামান্নাই দুই একটা কথার পরে বলল, আমার একটা কল এসেছে, তোমাকে দুই মিনিট পরে করছি।
মহিদ জানে সে আর করবে না। এই কথা আগেও বলেছে তামান্না। কল আর করে নি।
মহিদ ভেবে ছিল কথা বলে কিছুটা সময় কাটাবে। বড় একলা লাগছে আজ মহিদের।
অথচ কোন এক সময় গেছে, ওরা কথা বলেছে ঘণ্টা ধরে। সেইদিন গুলো অনেক পিছিয়ে গেছে।
বন্ধুত্ত ছিল।
ইদানিং মহিদের মনে হয়, ওটা ভাটার দিকে। কি কারন মহিদ জানে না। জানার ইচ্ছে নেই তার।
কথা হলনা।
জীবনে কখনও কখনও এমন সময় আসে যখন না চাইলেও একা থাকতে হয়। মহিদেরও হয়েছে তাই। ও তো একা থাকতে চায়নি কোনদিন। অনেকে বলে এ নাকি উপরওয়ালার একটা পরীক্ষা।
এই একাকীত্ব কাটানোর জন্যই সে চায় কারো সাথে কথা বলতে। কারো বাসার পার্টিতে যেয়ে আড্ডা দিতে।
এইতো গতকাল সুরাইয়ার বাসায় ছিল পার্টি। আগে মহিদ দাওয়াত পেতো। ইদানিং ডাকে না।
ও যেতে চায় শুধু সময় কাটাতে। আড্ডা দিতে।
বাহিরে ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নেমেছে।
মহিদ এসে দাঁড়াল জানালার কাছে।
মাঝে মাঝে কয়েকটা পাখি ওর জানালার কার্নিশে এসে বসে। বাসা বাঁধতে চায় ওর জানালার উপরে ছাদের কোনে।
আজ আসেনি।
ঘণ্টা দুই পরে সন্ধ্যা হবে। দিন বড় ছোট। শীতকাল। সময় কাটতে চায়না মহিদের।
এলো রেফ্রিজারেটরের কাছে। ডিপ ফ্রিজে ছোট ছোট পাত্রে রাখা মাংস,মাছ, ডাল আর তরকারি আছে।
এসবই এসেছে অরুনার কাছ থেকে। ও ক্যাটারিং করে।
মহিদ এক বন্ধুর কাছ থেকে খবর পেয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল একজনের জন্য উনি রান্না করেন কিনা। পরিমাণ যেহেতু খুবই কম।
রাজি হয়েছিল অরুনা। সেই থেকে ওর তৈরি খাবার থাকে মহিদের ফ্রীজে।
মাছ, ডাল আর তরকারি টা বের করলো মহিদ।
অথচ একসময় ওর টেবিলে থাকতো হরেক রকমের আইটেম। পাঁচ পদের নিচে কোনদিন সে দেখেনি টেবিলে।
কে যেন বলেছিল, তোর কোটা পুরন হয়ে গেছে। তাই তো তোর আজ এই দশা।
মহিদ আবারও এসে দাঁড়ালো জানালাটার কাছে। অন্ধকার হয়ে গেছে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে রাস্তার ওপারের বাড়ীটার বারান্দার আলো টা। মহিদ তাকিয়ে ছিল আলোটার দিকে। তার মনে হোল সে যেন নির্জন দ্বীপের একজন। চারদিকে ব্যস্ততা, গুঞ্জন, কোলাহল, আলাপ, কলকাকলি অথচ নিজে যেন এক অপার শূন্যতায়-মনের মাঝে এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার অন্ধকারে যেন ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে।
মহিদের মনে হয় আশে পাশে কেউ নেই তার, নেই কথা বলার কেউ।
আছে, আছে তার ছেলে, আছে তার মেয়ে। ওরা বলে এসো বাবা, থাকবে আমাদের সাথে।
কিন্তু ওতে মন ভরে না তার।
কি যেন নেই।
আস্তে আস্তে ক্রমেই যেন সে দুর্বল হয়ে পড়ছে। মহিদের শুধু মনে হয় একটা কথা বলার লোক যদি থাকতো , ফোনটা উঠালেই তাকে পাওয়া যেতো। বলতে পারতো সে মনের কথা, বন্ধু ভেবে আশ্বাস দিতো।
না, নেই।
ইদানীং মহিদের মনে পরে ফেলে আসা ছোট বেলার স্মৃতি গুলো। মাঠ, আম বাগান। বেনী পাগলি।
সেই আঁখের বাগান থেকে আঁখ কেটে পুকুর পাড়ে বসে খাওয়া।
গুলতি দিয়ে পাখি মারা।
কোথায় মুবা, কোথায় অণু, ধরাধামে আছে কি নেই জানে না মহিদ। চেষ্টা করেছিল ফেসবুকের মাধ্যমে। না, খোঁজ পাইনি।
ঘড়িটা দেখল মহিদ। রাত সাতটা। এই সময় সে ডিনার করে। একটা প্লেটের মধ্যে সব গুলো খাবার ঢেলে মিশিয়ে নিলো।
মাইক্রোওয়েভে গরম করলো। সব গুলো মিলে একটা জগাখিচুড়ি তৈরী হোল। প্রথমে ভেবেছিল ফেলে দেবে। এক গ্লাস দুধ খেয়ে রাত টা কাটিয়ে দেবে। কি ভেবে প্লেট টা টেনে নিলো ।
খাওয়া শেষে টিভি টা বন্ধ করে দিলো মহিদ। গায়ে গরম কোটটা চাপিয়ে দরজাটা খুলে দাঁড়ালো। ছিটে ছিটে বৃষ্টি পড়ছে এখন। বেড়িয়ে পড়লো রাস্তায়। দুই রাস্তা পাড় হলে একটা ক্যাফে আছে। ওখানে বসে কফি খাবে। মন টা হাল্কা হবে।
অনেক লোকজন থাকে সেখানে। কথা নাই বা হোল। একলা তো নয়।
এক কাপ কফি নিয়ে বসল জানালাটার কাছে।
দুটো এ্যাম্বুলেন্স শব্দ করে চলে গেলো। এ্যাম্বুলেন্সের শব্দ শুনলে ওর মনে একটা ভীতির সঞ্চার হয়। মনে হয় যে আছে ঐ এ্যাম্বুলেন্সের ভিতরে এ যেন তার শেষ ডাক।
জানালার থেকে চোখ টা সরিয়ে তাকালও বা দিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল একটু দুরের টেবিল টার দিকে। চেনা মনে হোল মহিলা কে। মনে করতে চাইলো কোথায় যেন দেখেছে সে। চোখ টা ফিরিয়ে নিলো কফির পেয়ালার দিকে।
মনটা কে এফোঁড়ওফোঁড় করল। মিললও না। অথচ মনে হচ্ছে কোথায় যেন দেখেছে তাকে।
ভাবল যেয়ে জিজ্ঞাসা করবে। সেকি কোথাও তাকে দেখেছে কিনা।
মনটা বাড়ন করছে, যাসনে মহিদ।
শুনলোনা সে। কফিটা হাতে করে এগিয়ে এলো টেবিল টার কাছে।
মহিলা তাকালও মহিদের দিকে। চোখে চোখ হল।
-কোথায় যেন দেখেছি আপনাকে। খুব ধীর স্থির গলায় বলল মহিদ।
মৃদু হাসল সে।
-কোথাও দেখা না হলেও এখানে তো দেখা হোল। বলে চোখের ইশারায় বসতে বলল মহিদ কে।
-বিরক্ত করলাম কি? কফিটা টেবিলে রেখে বলল মহিদ।
-না, বরং ভালো লাগছে কিছুক্ষণ কথা বলার একটা সাথী পেলাম। বলে চশমা টা খুলে গলার স্কার্ফ টা দিয়ে মুছল।
-না, মানে আমি আপনাকে—
কথা শেষ হোল না মহিদের।
-থাক সে কথা, কোথায় আগে দেখেছেন নাই বা মনে করতে পারলেন। এখন আমরা কথা বলি, সময় টা কাটাই। অতীত ঘেঁটে কি লাভ। বর্তমানই কি আসল না? বলে হাসল।
-হাঁ, অস্থির মন টা একটু শান্ত হোল আপনার সাথে কথা বলে। কি বলব? কোথা থেকে আরম্ভ করবো বলেন তোঁ?
-যা মনে আসে তাই বলুন। আমিও যা মনে আসে তাই বলব। তারপর কথা যখন ফুরিয়ে যাবে, আমরা উঠে পড়বো।
আপনি চলে যাবেন আপনার দিকে, আমি চলে যাবো আমার দিকে।
-আর দেখা হবে না? মহিদ কণ্ঠস্বর কাঁপা।
-না, আর দেখা হবে না। নির্লিপ্ত ভাবে বলল সে।
অনেক ঘণ্টা পেড়িয়ে গেলো। ওরা হাসল, হাসতে হাসতে চোখে পানি এলো।
দোকান বন্ধের সময় হোল।
ওরা এসে দাঁড়াল রাস্তায়।
দুজনে বিদায় নিলো দুজনের কাছ থেকে।
রাস্তা পাড় হতে হতে মহিদ বার বার মনে করতে চাইল, কোথায় যেন দেখেছি ওকে। কোথায়, কোথায়, কোথায়।
2 Comments
এক কথাই অপূর্ব এই গল্প।প্রতিটা পাঠকই অনুভব করবে এই গল্পের গভীরতা।
Enjoyed reading it. I like the end part…the best. Looking forward to reading more stories !