মিসেস পিটারশন আমার প্রতিবেশী। সকাল, সন্ধ্যায় ঘরের সামনের ছোট্ট বারান্ধায় চেয়ার নিয়ে বসে থাকে।
আসতে যেতে আমি হ্যালো বলি। মাঝে মধ্যে পাশের চেয়ার টা টেনে নিয়ে বসে গল্প করি।
এমনি এক সকালে কথায় কথায়, ওল্ড ইজ গোল্ড কথাটা বলতেই মিসেস পিটারশন ক্ষেপে উঠল।
তেতে মেতে বলল, ওল্ড ইজ গোল্ড কথাটা কে বলেছিল ? একবার তাকে দেখতে ইচ্ছে করে। ভালই তো ছিলাম। যেই ষাট পাড় হলাম অমনি রাজ্যের অসুখ এসে হানা দিলো। এখন গিটে গিটে ব্যাথা, সব মিলিয়ে পাঁচ থেকে ছয়টা ঔষধ খেতে হয়।
৬৫ বছর আমার ছেলেমেয়েরা ধুমধাম করে পালন করলো। বললও, আবার তুমি রিটায়ার করো।
করলাম। এখন প্রতিটি ঔষধে কো পেমেন্ট দিতে হয়। এই তোমার ওল্ড ইজ গোল্ড। গজরাতে গজরাতে মিসেস পিটারশন ভিতরে চলে গেলো।
আমিও রওয়ানা দিলাম।
কয়েকজন মিলে আড্ডা দেওয়ার কথা।
ইদানীং আড্ডার সুর পাল্টিয়েছে। আগের মতো হৈ হৈ নেই। বয়স সবার মিসেস পিটারশনের মত। কাজেই আড্ডা যদিও আরম্ভ হোল হাস্য রসিকতা নিয়ে, কিন্তু একটু জমে উঠতেই একজন বলে উঠল তার প্রেশার আজ তুঙ্গে উঠেছে। অমনি আর একজন সুর ধরল তার আজ দুদিন ধরে হার্টবীট টা বেড়েছে বলে মনে হচ্ছে। আলোচনা সীমাবদ্ধ হোল শারীরিক আর মানসিক অবস্থার মঝে।
বললাম, এইসব আলোচনা থাক।
রফিক বলে উঠল, তা আর কি নিয়ে আলোচনা করবো বলও। স্টক মার্কেট? ওটা একদিন নর্থে গেলে দুইদিন যায় সাউথে। বুক ধড়ফড় করে। ৪০১কে। ওটাই তো সম্বল। বৌ সেদিন রাগ করেছিল। বলল, সবকিছু বিক্রি করে দিয়ে টাকা মানি মার্কেটে রেখে দাও। তাহলেই তো কোন চিন্তা নেই। শোন কথা। বুক ধড়ফড় করলেও ওটাই একমাত্র একশাইটমেন্ট দেয়। কি বলিস?
হাঁ, অন্য সব একশাইটমেন্ট তো লাঠে উঠেছে। হাসতে হাসতে বললও শমিত।
আসলেই, বার্ধক্য খুব সুখের নয়। নানা রকম সমস্যা। শুধু তাই নয়, অন্যদেরকে ও বাতিব্যাস্ত করে তোলা।
মানুষ মানতে রাজি নয় যে সে বার্ধক্যে পৌছে গেছে।
এইতো কিছুদিন আগেও তো সে জোড়ে হাটতে পারতো, আজ কেনও তার হাঁটুতে ব্যাথা। সময় যে পেড়িয়ে গেছে তা সে জানতে পারেনি। ব্যস্ত ছিল ছেলে মেয়েদের লেখা পড়া নিয়ে। বাড়ী ঘর নতুন করে সাজান নিয়ে। ধাপে ধাপে উন্নতির পথে এগোন নিয়ে। বলা যায় এ এক কম্পিটিশন। শরীরে রোগ দেখা দেয়নি। শুধু কাশি সর্দি।
খেয়ে নেও দুটো পিল, চলো এগিয়ে।
সেই চলতে চলতে একদিন আয়নার সামনে দাড়িয়ে দেখল কয়েকটা পাকা চুল। চোখের নিচে পানির থলি।
হাটতে যেয়ে মনে হোলও একটু বিশ্রাম নিলে ভালো হতো।
সাড়া জীবন ব্যায়ামের ধার ধারেনি। কলকব্জা গুলোতে মরিচা পড়ে গেছে।
ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয়নি অনেকদিন হোল।
যদি বা গেলো, ডাক্তার ক্ষেপে উঠলো।
এতদিন কোথায় ছিলেন? কি ব্যাপার, খাওয়া দাওয়াতে কোন কন্ট্রোল নেই আপনার?
কলেস্ট্রল তো চুঙ্গে উঠেছে। ব্লাড প্রেসার তো আকাশ ছুঁই ছুঁই। ব্লাড সুগার আর নাইবা বললাম।
রোজ চার থেকে পাঁচটা ঔষধ খাওয়া আরম্ভ হোলও।
বাসায় এসে গেলো প্রেসার মাপার যন্ত্র, এসে গেলো সুগার মাপার যন্ত্র।
কি রে কিছু ভাবছিস? আনোয়ার ডাকে হুঁশ এলো শমিতের।
কি আর ভাববো, বড় বোন বাথরুমে যেতে যেয়ে পড়ে গেছে। মাথা তে চোট লেগেছে।
তারপর?
সিটি স্ক্যান করেছে। খুব একটা ভালো না। মাথায় রক্ত জমেছে। কথা জড়িয়ে আসছে।
আমাদের সবাই কে সাবধানে চলতে হবে। বললও গিয়াস।
তা আর বলতে। এইতো সেদিন হাটতে যেয়ে বাম দিকটাতে একটু চাপ অনুভব করলাম। পাত্তা দিলাম না।
বৌ এর চাপে পড়ে ডাক্তারের কাছে গেলাম। বলে বাবুল একটু দম নিলো।
কি বলেছে ডাক্তার, জিজ্ঞাসা করলো সানু।
এঞ্জীওগ্রাম করতে হবে। দেখবে কোন ব্লক আছে কিনা।
আমাদের সবাই কে এখন স্ট্রেস টা কমাতে হবে। স্ট্রেস কুড কিল ইয়ু। বললও সানু বিজ্ঞের মত।
স্ট্রেস কমাতে চাইলেই কমাতে পারবো ? মেয়েটার এখনো বিয়ে হয়নি। বয়স তো কম হোল না। বলে উদাস ভাবে তাকালও আকাশের দিকে বাবুল।
শোন, মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে। বাবা যখন রিটায়ার করল পঞ্চান্ন বছর বয়সে, ভেবে ছিলাম অনেক বয়স হয়েছে বাবার। আমাদের কিন্তু অনেক আগেই তা পেড়িয়ে গেছে। কাজ কমিয়ে দে। চল, জিমে যাওয়া আরম্ভ করি। বডি টাকে ফিট রাখতে হবে।
আমার কথা শেষ না হতেই রফিক বলে উঠল, কাজ কমিয়ে দেবো? এখনো মর্টগেজ রয়েছে। রিটায়ার করবো ভেবেছিলাম। হিসাব করে দেখলাম পোষাবে না।
যতটুকু গিলতে পারবে তার চেয়ে বেশি গলার ভিতর দিয়ে বসে আছো। তখন ভাবোনি। আসলে আমরা কেউই ভাবিনি একদিন বার্ধক্য আসবে। বিজ্ঞের মত বলল আমিন।
কিছুদিন আগে একজন আমার মেসেঞ্জারে কিভাবে চির তরুন ও নিরোগ থাকা যায় তার পদ্ধতি লিখে পাঠিয়েছি।
অবশ্য এটা একটা বিশ্বখ্যাত চিকিৎসকের পরামর্শ। বললাম।
কি বলেছে সে? উদগ্রীব হয়ে শুনতে চাইল সানু।
সকালে ঘুম থেকে উঠে গরম পানি খাওয়া। দুধ ছাড়া চা। সারা দিনে আট থেকে বারো গেলাস পানি খেতে হবে।
ধূমপান নিষিদ্ধ। রেড মিট অর্থাৎ গরু,খাসি, ভেড়ার মাংস খাওয়া ছেড়ে দিতে হবে।
হয়েছে হয়েছে আর বলতে হবে না, ওসব আমার দাড়া হবে না। মাঝ পথে থামিয়ে দিলো আমিন। কবে, কখন কোথায় মরবো তাতো লেখাই আছে। এসব তথ্য শুনে লাভ নেই।
আল্লাহ না করে যদি তোর স্ট্রোক হয়। একটা দিক অবশ হয়ে যায়। তোকে দেখবে কে? তুই তো বোঝা হয়ে থাকবি অন্যের। বলে সানু তাকাল আমিনের দিকে।
শোন আলোচনা এখানেই শেষ কর। যেতে হবে নাতিকে দেখতে। তবে আমার একটা প্রস্তাব।
কি? সবাই উদগ্রীব হয়ে শুনতে চাইল।
প্রতি সপ্তাহে রবিবার সকালে আমরা মিলিত হবো নাস্তা খেতে। একঘণ্টা দুইঘন্টা কাটাবো গল্প করে। অসুখের কথা নয়। শুধু মন মাতানো কথা। রাজি?
রাজি? আমি আর একটা জিনিস যোগ করতে চাই। বলল আমিন।
কি?
প্রতি মাসে একবার আমরা মুভি দেখতে যাবো। রাতের শো তে। গৃহিণী দের কে বাসায় রেখে?
হাসতে হাসতে সবাই বললও রাজি।
আলবৎ রাজি।