শীতের সকাল। ঘুম থেকে উঠে কফি টা নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম বাহিরের দিকে। গুঁড়িগুঁড়ি বরফ পড়ছে। বাহিরে যাবার ইচ্ছে নেই আজ। ভালো লাগতো এই বরফ পড়া দেখতে প্রথম জীবনে। আজ আর লাগেনা। সাইদ আসবে বলেছে বিকালে আড্ডা দিতে। ওর বৌ গেছে দেশে।
ভাবলাম, বহুকাল ধরে জমানো কাগজপত্র গুলো ফেলতে হবে। ফেলতে যেয়ে হাতে পড়লো অনেক আগের একটা পুরানো ছবি। আমার আর শমসেরের। স্কুলে পড়া কালীন ওঠানো ছবি। ঐ ছিল আমার সব চেয়ে কাছের বন্ধু।
নাটোর। বাবার বদলি চাকরি। পোস্টিং হয়েছিল নাটোরে। তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র আমি। প্রথম দিন শমসেরের পাশেই বসেছিলাম। সেই থেকে বন্ধুত্ব শুরু। ওর বাবার ছিল কাঠের ব্যাবসা, ছিল কয়েকটা বাস। বিশাল জমি নিয়ে ওদের বাসা। তার পাশেই ছিল আমাদের বাসা টা।
সে আজকের কথা নয়। কত স্মৃতি ভরা সেই দিনগুলো।
যে কাজ করবো বলে হাত দিয়েছিলাম, তা আর হোল না। ছবি টা নিয়ে ড্রয়াইং রুমে এসে বসলাম। শমসেরের সাথে শেষ কথা হয়েছিল আজ থেকে দুই বছর আগে। চোখের সামনে ভেসে উঠল ওদের বাসার পিছনের সেই আম বাগান কাঁঠাল বাগান গুলো।
ওর ফোন নাম্বার টা বের করলাম।
-হ্যালো
-কিরে চিনতে পারছিস।
-না পারার কী কোন কারন আছে বন্ধু। তা কী মনে করে?
-ভাবছি ঘুরতে আসবো তোর ওখানে। সময় হবে তোর।
-আলবৎ, কবে আসবি? আমার চেহারা তোর মনে আছে তো?
– ফাজলামি ছাড়। আর শোন, ঢাকা থেকে ট্রেনে আসবো। ষ্টেশনে থাকবি।
দেরী করিনি আমি। অনেকদিন বাহিরে যাওয়া হয়নি। মনটাও ছুটে গিয়েছিল। টিকেট কেটে উঠে পড়লাম প্লেনে সাতদিন পর। তারপর ট্রেন ধরে এসে পোঁছালাম নাটোরে। তখন সন্ধ্যা।
নামলাম। দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো শমশের। জড়িয়ে ধরলও। সাথে দুজন। আমার ল্যাগেজ টা ওরা নিয়ে নিলো।
-বেশ মুটিয়েছিস দেখছি। হাসতে হাসতে বললাম।
– তোর তো কোন পরিবর্তন নেই শুধু পাঁকা চুল আর এই মোছ টা ছাড়া। বলতে বলতে আমার হাতটা ধরে রাখল।
বাহিরে দাঁড়ানো ছিল ট্যাক্সি। ভাড়া করে এনে ছিল। চারিদিক দেখতে দেখতে যাচ্ছি। মনে হোল অনেক পাল্টে গেছে এই শহর টা। না পালটানোর কথা নয়। যখন এখানে ছিলাম বয়স ছিল দশ আর বিশের মাঝে। আজ সত্তর পেড়িয়ে গেছে।
শমসেরদের বাসার খুব একটা পরিবর্তন নেই। শমসেরের বৌ দরজা খুলে দিলো। এই প্রথম দেখলাম। বাচ্চারা বড় হয়ে চলে গেছে দুরে। বাড়ীতে শুধু ওরা দুজন।
-আসুন, আপনার কথা অনেক শুনেছি ওর কাছে। বলে দরজাটা খুলে ধরল।
অনেক রাত কাটিয়েছি ছোট বেলায় এই বাড়ীতে। খালাম্মার হাতের মুড়িঘণ্টের স্বাদ আজও মুখে লেগে রয়েছে।
-তুই হাত মুখ ধুয়ে নে। খাবারের ব্যবস্থা করতে বলি। বলে পাশে দাড়ানো লোক টাকে বলল আমার সুটকেস টা ঘরে নিয়ে রাখতে।
আমি গোসল সেরে এসে দাড়ালাম বাড়ীর বারান্দায়। দুটো চেয়ার পাতা। চাঁদের আলো এসে পড়েছে বারান্দাতে। মনে হোল আজ পূর্ণিমা।
শমসের এলো দুই গ্লাস ভর্তি আমের সরবত নিয়ে।
-ধর, বৌ বলল খাবার আগে এটা খেলে নাকি খিদে বাড়ে। বলে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।
গ্লাসটা হাতে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, এখানকার সবাই কে কেমন আছে।
-তুই কী অন্যদের কথা জানতে চাইছিস না অনুর কথা। বলছি।
বলা হোল না। শমসেরের বৌ ডাক দিলো ডিনার খেতে।
খাওয়া শেষে শমসের বলল, তুই আজ বিশ্রাম নে, আমাকে একটু যেতে হবে বাহিরে। একটা বাসে কী যেন গণ্ডগোল হয়েছে।
সকালে সব কথা হবে। দেখাবো তোদের বাসাটা আর অনুদের টাও।
কখন যে দুচোখ বুজে গিয়েছিল মনে নেই। চুড়ির টুংটাং আওয়াজে ঘুমটা ভেঙে গেলো। পুরো ভাঙেনি। আধো ঘুমে তাকালাম। মনে হোল কে যেন দাড়িয়ে আছে দরজার কাছে। শাড়ী পড়া। মনে করার চেস্টা করলাম দরজার ছিটকিনি দিয়ে ছিলাম কিনা।
মাথার চিন্তার জট ছাড়ানোর আগেই সে এসে দাঁড়ালো আমার বিছানার পাশে। আমি তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে।
-চিনতে পারছ?
সে কথা বলছে। আমি তাকিয়ে দেখলাম, মনে হোল এত সেই অনু। যার সাথে আমি খেলতাম।
-অনু তুই? এত রাতে।
-এসো আমার সাথে। বলে সে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো।
আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত ওকে অনুসরণ করলাম। আমি কী স্বপ্ন দেখছি? এক মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়েছিলাম।
ও বলল, কী দাড়িয়ে আছো কেনও, এসো।
এলাম বারান্দায়, সিঁড়ি বেয়ে উঠানে। জ্যোৎস্নার আলোতে আলোকময় চারিদিক। অনু এসে আমার হাতটা ধরে বলল, তাহলে আমাকে চিনতে পেরেছ অনীকদা। চলো হেটে আসি।
-তুই কোথা থেকে এসেছিস। এত রাতে?
ও কোন উত্তর দিলো না।
হাটতে হাটতে আমরা এলাম আম বাগানে। ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকছে। আধো আলো আধো অন্ধকার।
ও দাঁড়ালো। তাকালও আমার দিকে।
-মনে পড়ে কী, তুমি আমি কত হেঁটেছি এই বাগানের ভিতর দিয়ে। এই আম গাছটার নিচে বসে আম খেয়েছি। তুমি ঢিল দিয়ে আম পারতে। আমি বাসার থেকে লবণ আর ঝাল নিয়ে আসতাম। আম কেটে কেটে আমি মাঝে মাঝে তোমার মুখে দিতাম। মনে পড়ে কী?
-হ্যাঁ, পড়ছে।
আমি যেন ফিরে যাচ্ছি অনেক অনেক পিছনে।
-ছোটবেলা থেকে আমি তোমার সাথে ঘুরতাম। তুমি আমাকে নিয়ে গিয়েছিলে চরক মেলায়। হঠাৎ তুমি আমাকে ফেলে কোথায় যেন চলে গিয়েছিলে। আমি চিৎকার করে কাঁদছিলাম। মনে হয়েছিল আমি আর ফিরে যেতে পারবনা। তুমি ফিরে এসে বললে, এই পাগলি কাঁদছিস কেন? বলে তোমার হাত দিয়ে আমার চোখ দুটো মুছিয়ে দিয়েছিলে। মনে কী পড়ে তোমার অনীকদা?
ও তাকালও আমার দিকে।
-চলো তোমাকে নিয়ে যাবো সেই শান বাঁধানো পুকুর পাড়ে। যেখানে আমরা শুয়ে শুয়ে আকাশে উড়া পাখি দেখতাম। তুমি বলতে, জানিস আমি একদিন ওদের মত উড়ে চলে যাবো অনেক দুরে।
সেই তো চলে গেলে অনেক দুরে আর ফিরে এলে না। আজ কেনই বা এলে অনীক দা।
-জানিনা, হঠাৎ মনে হোল, চলে এলাম। তোর পড়নে এই লাল শাড়ী কেনও। এত বিয়ের শাড়ী। তোর বয়স একটুও বাড়েনি অনু।
-বলব সব। আচ্ছা অনীক দা মনে পড়ে তুমি একদিন উঠানে বসে কী যেন করছিলে আমি এসে তোমার পাশে দাঁড়ালাম। ভর সন্ধ্যা। খালাম্মা বলেছিল, কিরে অনু এই সন্ধ্যায়? আমি বলেছিলাম, অনীকদার সাথে একটা কথা আছে। খালাম্মা আর কিছু না বলে রান্না ঘরের দিকে চলে গিয়েছিল।
-না মনে করতে পারছিনা।
– তা পারবে কেন। এসেছিলাম বলতে, মা বাড়ন করেছে তোমার সাথে ঘুরতে। আমার নাকি বয়স হচ্ছে। আমি ওড়না ধরেছি। এখন ছেলেদের সাথে নাকি মেলামেশা করতে নাই।
তুমি আমার গায়ে একটা চিমটি কেটে বলেছিলে, ওরে বাবা, তুই বড় হয়েছিস। আমিতো এখনো হ্যাফপেন্ট পড়ে ঘুরে বেড়াই। বলে এক হাসি দিয়ে সব কথা উড়িয়ে দিলে।
আচ্ছা অনীকদা, আজ এতদিন পড়ে আমাকে দেখে তোমার কী মনে হচ্ছে বলও তো?
-মনে হচ্ছে, তোকে এই বেশে আমি কখন দেখিনি।
-বলেছি তো সে কথা পড়ে বলব। ওই যে দেখছ ওটা কী বলতো?
-ওমা, ওটা তো সেই বট গাছ। শান বাঁধানো চারিদিক। যার চত্বর তুই আর আমি বসে বসে গল্প করতাম। মনে পড়ে একদিন এক জট ধারী সাধু এসে বসে ছিল আমাদের পাশে। তুই ভয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলি। সাধু কটমট করে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। উঠে যাবার সময় বলেছিল, এই ছুঁড়ী এই দুপুর বেলা চুল ছেড়ে এই বট তলায় থাকিস নে। অমঙ্গল হবে।
-তা সেই অমঙ্গলই তো হোল অনীকদা। চলো ঐ বটগাছ টার নিচে আবার আমরা বসি।
-কী অমঙ্গল?
-বলব, সেটা বলতেই তো আজ আমার আসা। তুমি ছিলে স্কুলের শেষ ক্লাসের ছাত্র। তখন তুমি হ্যাফপেন্ট ছেড়ে পাজামা ধরেছ। মা র কথা শুনিনি আমি। তোমার ঘরে এসে বসে থাকতাম। তুমি মাঝে মাঝে তোমার বিদ্যা আমার উপর ঝারতে। বলতে, জানিস আমি একদিন অনেক দূরদেশে চলে যাবো। আমি বলতাম, আমাকে নেবে তোমার সাথে অনীকদা। তুমি বলতে তোর মা বাবা যদি রাজি থাকে তাহলে তোকে নিয়ে যাবো আমার সাথে। তখন কী কোন কিছু ভেবে বলতে না এমনিই বলতে অনীক দা।
-কী জানি। মনে করতে পারছিনা, কী ভেবে বলতাম।
-জানো অনীকদা, যেদিন তুমি এসে আমাকে বলেছিলে, খালুর বদলির অর্ডার এসেছে। সামনের মাসে তোমরা চলে যাবে। সেদিন আমি পাগলের মত চারিদিক ছুটে বেড়িয়ে ছিলাম।
এই বট তলায় এসে বসে ছিলাম চুল ছেড়ে।
যাবার দিন তুমি এসে বলেছিলে, অনু আমি যাচ্ছি। আবার আসবো। তুমি কথা রাখো নি। তুমি আর আসোনি। যাবার দিন তোমার মুখমণ্ডলে পিছনে কিছু ফেলে রেখে যাচ্ছ সে চিহ্ন আমি দেখিনি।
-আমি ব্যাস্ত হয়ে পড়েছিলাম আমাকে নিয়ে। আমার ভবিষৎ নিয়ে।
-বলেছিলাম সব কথা বলব, তবে শোন, ওমা, ওই দেখো টর্চের আলো। কারা যেন এদিকে আসছে। আমাকে চলে যেতে হবে। আমি চললাম, আর বলা হোল না আমার কথা।
– অনু যাসনে।
আমি ওকে ধরতে চাইলাম। পাড়লাম না। ও দ্রুত মিলিয়ে গেলো। টর্চের আলো টা এসে পড়লো মুখে।
শমসেরের গলার আওয়াজ।
-তুই এখানে কী ভাবে এলি।
আমার মনে হোল আমি একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম।
-অনু, হ্যাঁ অনু আমার ঘরে এসেছিল। সেই তো নিয়ে এলো আমাকে এইখানে। ওর পড়নে ছিল লাল শাড়ী, বিয়ের শাড়ী।
-কী বলছিস আবোল তাবোল।
-হ্যাঁ, ঠিকই বলছি। এসেছিল, বিয়ের শাড়ী পড়ে। আমি কী ঘুমের মাঝে হাটতে হাটতে চলে এসেছি এইখানে? না, ওতো আমার হাত ধরে নিয়ে এলো। তারপর তোর টর্চের আলো দেখে চলে গেলো। তোর সামনে আসতে চাইল না।
-কারন সে নেই।
বলে টর্চের আলো গাছের একটা বড় ডালের উপর ফেললো শমসের। বলল, ওই যে দেখছিস ডাল টা, ওটাতেই অনুর দেহটা ঝুলছিল।
আমার সারা শরীর হীম হয়ে এলো।
-অনু কী যেন বলতে চেয়েছিল। বলতে পারেনি, তুই চলে এলি।
শোন, অনুর বিয়ে হয়েছিল এক ব্যাবসায়ীর সাথে। পাঁটের ব্যাবসা করে। দুশ্চরিত্র, মদখোর।
অনুকে মারত। একদিন বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল। অনু ফিরে এলো ওর মা,বাবার কাছে।
এখানেও ওর শান্তি হোল না। একদিন সেই বদমাইশ এসে ওকে নিয়ে যেতে চাইল।
সে বলল আজ যাবো না, কাল সকালে যাবো।
সেই সকাল আর আসেনি। সেই রাতেই বিয়ের শাড়ীটা পড়ে এসেছিল এই বটগাছের নিচে।
অনেকে বলে পূর্ণিমা রাতে এই গাছের নিচে নাকি লাল শাড়ী পড়া মেয়েকে হাটতে দেখেছে। কাঁদতে দেখেছে। তাই এদিকটাতে সন্ধ্যার পর কেউ আর আসে না। আজ তো পূর্ণিমা।
চল, ঘরে চল। সকাল হতে এখনো অনেক দেরী।
বললাম একটু বস।
–
–