প্রতিভা

  একদিন কাজ থেকে ফিরে এসে গিন্নিকে বললাম, জানো আজ থেকে আমি গল্প লিখতে শুরু করব। আমি সাহিত্যিক হবো। আমার মধ্যে প্রতিভা আছে মনে হচ্ছে। প্রথমে গিন্নি গুরুত্ব দিলো না আমার কথায়। আর একবার বলতেই উননের আঁচ টা একটু কমিয়ে দিয়ে তাকালও আমার দিকে।

-কি বললে, কি হবে?

– সাহিত্যিক।

-রসিকতা না করে গোসল করে এসো। রান্না শেষ। বলে খুন্তি টা দিয়ে কড়াই এর মধ্যে যা ছিল সেটা নাড়াচাড়া করতে থাকলো। 

বুঝলাম উলো বনে মুক্ত ছড়িয়ে লাভ নেই। আমার সিদ্ধান্ত আমাকেই নিতে হবে।

পরের দিন খাতা পত্র কিনে ফেললাম। যথারীতি রাতের খাওয়া শেষে টেবিল চেয়ারে বসলাম। কলম টা কয়েকবার মাথায় ঠোকাঠুকি করে, চোখ বুজে, ভাবতে থাকলাম কোথা থেকে আরম্ভ করবো।

এক ঘণ্টা কেটে গেলো, একটা বাক্যও লেখা হলো না। 

এর মধ্যে গিন্নি তাগীদা দিয়ে গেছে বিছানায় যেতে। ভাবলাম আজ হবে না, মাথায় প্লট আসছে না। বড় বড় সাহিত্যিকরা কি একদিনেই বড় সাহিত্যিক হয়েছিল। মন কে সান্ত্বনা দিয়ে বিছানায় চলে এলাম। গিন্নি তখন গভীর ঘুমে।

পরের দিন কাজে লাঞ্চের সময় দুই তিনজন কলিগ মিলে আড্ডা দিচ্ছি। হঠাৎ মুখ থেকে বেড়িয়ে এলো আমি সাহিত্যিক হবো।

কাঞ্চন কেবল স্যান্ডউইচ টাতে কামড় বসিয়ে ছিল। ওটা বেড়িয়ে এসে থালাতে পড়ে গেলো।

ওরা তিন জন তাকালও আমার দিকে। যেন অবিশ্বাস্য কোন কথা আমি বলে ফেলেছি।

-কেন? লেখা আমার মাথা দিয়ে আসবে না বলে তোদের মনে হয়।

-না না তা নয়। বলে সুমন্ত কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। তারপর বলল, শোন লিখতে হলে পড়তে হবে, পড়তে হবে বিভিন্ন লেখকের বই। শুধু বাংলা সাহিত্য নয়। তার বাহিরেও।

কথাটা মনে ধরলও।

পরের দিন কাজ থেকে ফেরার পথে গেলাম সাগরের বই এর দোকানে। কিনা ফেললাম গোটা দুই তিন বই। বাসায় ফিরতে একটু দেরী হয়েছিল সেদিন।

বাসাতে ঢুকতেই আমার মেয়ে শমিতা হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো বারান্দায়। চুপিচুপি বলল, মা র মেজাজ টং হয়ে রয়েছে।

জিজ্ঞাসা করলাম, কেন?

-ভুলুর মা এসেছিল, তার সাথে কথা বলার পরই— কথা শেষ না করেই দৌড়ে চলে গেলো তার ঘরে। 

আমার মেয়ে শমিতা মাত্র দশ বছর হলে কি হবে সেই আমাকে আগলিয়ে রাখে। 

ঘরে ঢুকে দেখলাম গিন্নির চেহারা টা আষাঢ় মাসের মেঘের মত হয়ে আছে। আমার হাতে তখনো রয়েছে তিনটা বই। বই গুলো টেবিলের উপর রাখতেই গিন্নির রাগ এসে পড়লো আমার উপর।

-এইগুলো কি?

-বই।

-হঠাৎ বই পড়ার শখ হোল কেন?

-বই না পড়লে জ্ঞান হবে না আর জ্ঞান না  হলে লেখা আসবে না।

-রাখো তোমার লেখা। সবার চাকরিতে উন্নতি হচ্ছে আর তোমার কি হচ্ছে? সেই একি জাগায় তো পড়ে আছো আজ এত বছর।

বুঝলাম এসবই ওই ভুলুর মার ব্যাপার।

কথার উত্তর না দিয়ে ঢুকে পড়লাম বাথরুমে। এই একটা জায়গা যেখানে পুরোপুরি তুমি স্বাধীন। কলটা ছেড়ে দাও, মনের সুখে গান করো।

একটু সময় নিয়ে বের হলাম বাথরুম থেকে। সময় যত পাড় হবে রাগ টা তত পড়ে যাবে। এই পদ্ধতিতে আমি বিশ্বাসী।

তাই হোল। এক সাথে রাতের খাওয়া টা শেষ করলাম। মেয়েটা এসে আমার পাশে বসলো। ওর ঘন চুলের ভিতর হাত বুলাতে বুলাতে আমি একটা বই হাতে তুলে নিলাম।

বেশ কয়েকটা দিন কেটে গেলো। বইগুলো পড়ে শেষ করেছি। কিন্তু মাথা দিয়ে লেখা বের হোল না। মেয়ে এসে জিজ্ঞাসা করে, বাবা কিছু এলো।

বললাম, না মা, এলো না।

 অগত্যা, ইস্তফা দিলাম।

বেশ কিছুদিন চুপচাপ কেটে গেলো। একদিন আড্ডার আসরে কলীম বলল, এই মহি তুই তো বেশ ভালো বক্তৃতা দিতে পারিস, রাজনীতিতে নেমে যা না।

ওর কথাটা কানে বাজতে থাকলো।

রাজনীতি নিয়ে কোনদিন আমি মাথা ঘামাই নি। স্কুল জীবনে একটু আধটু করেছি। সেই শেষ।

কে যে কোন দলে আছে খোঁজ রাখি না।

একদিন আমি আর কবীর বসে চা খাচ্ছিলাম এক রেস্টুরেন্টে।

এমন সময় একজন এলো, সাথে অনেক চেলা চামুন্ডা। পিছনের দিকে বেশ কয়েক টা চেয়ার টেবিল নিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টের কর্মচারীরা উনার সেবা তেই মগ্ন হয়ে গেলো। দুই একজন কে ডেকেও কাছে আনা গেলো না।

কবীর বললও, চিনিস ওকে?

বললাম, না।

-অমুক দলের উঠতি নেতা।

সেই নেতার হঠাৎ করে চোখ পড়লো আমার দিকে। উঠে এলো আমার টেবিলে।

তাকালও আমার দিকে। চোখাচোখি হোল। চিনতে পাড়লাম না।

-মহি না? বলে আমার কাধে একটা থাপ্পড় দিলো।

আমি অবাক চোখে তাকিয়ে রইলাম।

-শালা, রজত, সেই স্কুলের সাথী।

এইবার মনে পড়ল। সেই হ্যাংলা পাতলা ছেলেটা। আমার পাশে বসতো। অংক, বাংলা, ইংরাজি কিছুই বুঝতে পারতো না। আমাকে ধাক্কা দিয়ে বলত, এটা তো কিছুই বুঝলাম না। ওর জন্য কত বার আমি মাস্টারের কাছে বকা খেয়েছি। প্রথম বার এস,এস,সি পরীক্ষায় সে পাশ করতে পারেনি। সেই শেষ দেখা আমার সাথে।

-কিরে হা হয়ে গেলি।

-তা  হা হওয়ার মতোই তো ব্যাপার। আমার বন্ধু বলছিল,তুই উঠতি নেতা।

-ওসব কথা থাক, কাল বন্ধের দিন, অবশ্য আমার সবদিনই সমান।  বিকেল পাঁচটায় আমার বাসায় আয়। অনেক কথা আছে।

বলে একজনের কাছ থেকে কাগজ কলম নিয়ে ফসফস করে ওর ঠিকানা টা লিখে আমার হাতে গুজে দিলো।

বাসায় এসে গিন্নিকে বলতেই সে আমাকে জড়িয়ে ধরল। ভুলে গিয়েছিল মেয়ে পাশে দাড়িয়ে।

জিজ্ঞাসা করলাম তোমার এত উৎফুল্ল হওয়ার কারন?

-উনাকে চেননা তুমি, উনি উঠতি নেতা। তোমার বাল্যবন্ধু। তোমাকে উনার বাসায় যেতে বলেছে। এত বিরাট ব্যাপার।

-ও নেতা তাতে আমার কি যায় আসে। বলে আমি জুতো মোজা খুলতে লাগলাম।

-তোমার দাড়া কিচ্ছু হবে না। উনাকে বলে প্রমোশন টা করিয়ে নিতে পারো কিনা দেখো।

রাতে ঘুম এলো না। যাবো কি যাবো না এই দ্বন্দ্বের মধ্যদিয়ে রাতটা কেটে গেলো। গিন্নির পিড়াপিড়ি আর নিজের ও জানতে ইচ্ছা করছিল এই এস,এস,সি ফেল করা ছেলে টা আজ এইখানে উঠলো কি ভাবে।

বিশাল বাড়ি। মোজাইকের তৈরী মেঝে। দামী সোফা। দালানে আর্ট ঝুলছে। ও আর্টের কি মর্ম বোঝে আমি বুঝতে পাড়লাম না। যাহোক সে নিজে এসে আমাকে দরজার থেকে নিয়ে গেলো।

চা , সমুচা, নুডুলস এসে গেলো।

চা র পেয়ালায় চুমুক দিয়ে বললাম, কবে থেকে রাজনীতি শুরু করেছিলি।

– এস,এস,সি টা পরে অবশ্য পাশ করেছিলাম। কলেজে এসে ছাত্র রাজনীতি আরম্ভ করলাম। তারপর ধীরে ধীরে  এই পর্যন্ত এসেছি। তোদের দোয়ায় দুটো গারমেন্টস ইন্ডাস্ট্রি দিয়েছি। চার পাঁচ টা বাড়ি আছে অমুক জায়গায়।

শোন তুই ও রাজনীতি তে ঢুকে পড়। আমি সাহায্য করবো। তোর তো মাথা আছে, অবশ্য এই পথে মাথা থাকার কোন দরকার নেই।

-কেন? জিজ্ঞাসা করলাম আমি।

-শুধু কথা বেচে খাবি। দেখবি টিপস আসছে।

-টিপস মানে? আমি দুই চোখ বড়বড় করে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম।

-আহ, তুই একটা বোকা। কাউকে সাহায্য করলি,টেন্ডার টা পাইয়ে দিলি।  তার পরিবর্তে সে খুশি হয়ে টিপস দিলো। বুঝলি কিছু?

-হা, বুঝলাম, কিন্তু আমি তো জনগনের সেবা করতে চাই।

-গুলি মার তোর জনগনের সেবা। আগে নিজের সেবা কর। দেখছিস না চারিদিক। নিজের আঁখের গুছাতে ব্যাস্ত সবাই।

-না, তাহলে আমার দাড়া এ হবে না।

-তাহলে তোকে সারা জীবন ওই ঘানিই চালাতে হবে। বলে সিগারেটের প্যাকেট টা বের করলো।

গিন্নি বলে দিয়েছিল ওকে বলে আমার প্রমোশন টা করে নিতে। আর তা নাহলে ওর ডানহাত হয়ে আপাতত কাজ করতে। তাহলে ভবিষ্যতে আমি একটা কেউকেটা হতে পারবো।

কিন্তু আমি পাড়লাম না। ওকে আমার প্রমোশনের কথা বলে আমার উচু মাথাটা নিচু করতে পাড়লাম না।

আমি চলে এলাম।

রিক্সার টুংটুং শব্দ শুনে দরজা খুলে দাড়ালো আমার মেয়ে। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা তোমার কিছু হয়েছে?  তুমি মনমরা কেন? বলে আমার হাত টা চেপে ধরলও।

-আমি কিছুই হতে পাড়লাম না, মা। না সাহিত্যিক, না রাজনীতিবিদ। আমার প্রতিভা নেই। বলতে বলতে গলায় কান্নার স্বর টা আমি শুনতে পেলাম।

–তোমার যা আছে তা অনেকরই নেই বাবা। বলে সে আমাকে নিয়ে বারান্দায় এসে বসলো।

তারপর আমার খুব কাছে এসে বলল, মনে পড়ে বাবা, তুমি আমাকে মাঝ রাতে উঠে কোলে করে দুধ খাওয়াতে। শুনেছি মা র কাছে।

 আমার পেম্পার পালটিয়ে দিতে।

আমি হাটতে শিখলে তুমি আমার ছোট হাতটা ধরে বাহিরে হাটতে নিয়ে যেতে। রাস্তায় কাউকে দেখলে বলতে,

দেখো দেখো আমার মা হাটতে শিখেছে।

তারপর আস্তে আস্তে আমি যখন আর একটু বড় হলাম, একদিন আমার প্রচণ্ড জ্বর এসেছিল। তুমি সারা রাত আমার পাশে বসে আমার কপালে ঠাণ্ডা পানির পট্টি দিয়েছিলে।

আমার দশ বছর বয়সেও এখনো তুমি মাঝে মাঝে আমার চুল আঁচড়িয়ে দাও। পাশে বসিয়ে বল, দেখি মা তোর মুখটা, এত মেয়ে দেখি এমন সুন্দর মুখ তো দেখি না।

তুমি কি, তা তুমি জানো না বাবা। তুমি হচ্ছ আমার কাছে পৃথিবীর সব চেয়ে সেরা বাবা।

বলে সে আমার কোলে মাথাটা রেখে বলল, তুমি কাঁদছ বাবা।

বললাম, না মা, চোখে কি যেন পড়েছে, বলে মেয়েটার মাথা টা চেপে ধরলাম বুকে।

আমার বুকটা শান্তিতে ভোরে গেলো।

,

You may also like

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *