কত দেখা কত স্মৃতি

  হঠাৎ করে চোখে পড়ল গেট ১ এর একটা বিজ্ঞাপন। অস্ট্রেলিয়া , নিউজিল্যান্ড। ১৪ দিনের সফর। দাম টা কম মনে হোল। তিন বন্ধু কে ফোন করলাম। তিনজন রাজি। দুই মাস পরে যাত্রা। কোথা দিয়ে কেটে গেলো দুটি মাস। আমরা রওয়ানা হলাম।  নিউইয়র্ক থেকে লস অ্যাঞ্জেলেস। সেখান থেকে সিডনি। সব মিলিয়ে উনিশ ঘণ্টার পথ। প্লেনে পরিচয় হোল দুই জনের সাথে। ওরাও একই প্যাকেজ নিয়েছে। প্লেনে বাধ্যতা মূলক ম্যাস্ক পড়ার নিয়ম আজ আর নেই। যাক বাচা গেলো। এই ভেবে সীট বেল্ট টা বেঁধে বসলাম। প্লেনে কোনদিনই আমি ঘুমতে পারিনা। অথচ সেইদিন ঘুম এসে গেলো। ছেলে মেয়েরা বলে দিয়েছে উঠে হাটা চলাফেরা করতে। করিনি যে তা নয়। তবে অতটা নয়।

অকল্যান্ড থেকে প্লেন চেঞ্জ করে সিডনিতে যখন এসে পৌছালাম তখন সকাল সাড়ে দশ টা। হাতে ফ্ল্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল আমাদের ট্যুর গাইড। পরিচয় হোল। নাম ডানা। আমাদের গ্রুপে সব মিলিয়ে ১৬ জন। সবাই আমরা আমেরিকার থেকে এসেছি। বিরাট বাসের ভিতর আমরা ১৬ জন। বাহিরে ঝলমলে রৌদ। তাপমাত্রা ৬৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট। নিয়ে এলো হোটেলে। Rydges World Square. লোকেশন টা এমন এক জায়গায় যেখান থেকে বিখ্যাত অপেরা হাউস খুব বেশি দুরে নয়। দুরে নয় হাইড পার্ক।

লম্বা একটা ঘুম দিলাম রুমে এসে। রাতে দেখা হোল ডিনারে সবার সাথে। নাম আদান প্রদান হোল।

রাতের ঘুম টা খুব একটা ভালো হোল না। নাই বা হোল। এসেছি আনন্দ ফুর্তি করতে। ঘুম নিয়ে গবেষনা করলে তো চলবে না। সকাল সাতটার সময় নিচে নেমে এলাম। নয়টায় গাড়ী আসবে। ডাইনিং রুমে এলাম।

 বিভিন্ন রকমের নাস্তা সাজানো। চার জনের একটা টেবিল নিয়ে আমরা চারজন বসলাম।

আব্বাস আর নাফীসা সুপ্রভাত জানালো টেবিলের কাছে এসে। ওরা এসেছে শিকাগোর থেকে। পাশের টেবিলে বসা সেন্ডী আর বারবারা।

এগ হোয়াইটের অমলেট অর্ডার দিয়ে কফির সরঞ্জামের দিকে এগিয়ে গেলাম। সকালের কফির স্বাদই আলাদা। ওটা নাহলে আমার দিনই অচল। বড় একটা প্লেটে সাজিয়ে নিলাম চিকেন সসেজ, পটেট ফ্রাই, ডেনিশ আর টোস্ট। কিছুক্ষণ পরেই ওয়েটার এসে দিয়ে গেলো অমলেট টা।

খাওয়ার মাঝেই কাঁধের উপর একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করলাম। ঘাড় ফিরে তাকাতেই ডানা বলল, ঘুম হয়েছে কি?

-না তেমন আর হোল কই। বলে হাসলাম।

-নয় টায় আমরা বেড়িয়ে পড়বো। পানি গাড়ীতে আছে। বলে সে অন্য টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো।

সিডনি তে আসবে আর অপেরা হাউস দেখবে না তা হলে তো এখানে আসাই বৃথা। দেখলাম। দেখলাম হারবার ব্রিজ।

সেলফী উঠানোর চেস্টা করছিলাম অপেরা হাউস আর ব্রিজ টাকে নিয়ে,

-আমাকে দাও তোমাদের সবার ছবি উঠিয়ে দেই। সোনালী চুল গুলো ঘাড়ের পাশে সরিয়ে দিয়ে বলল, বারবারা।

-অবশ্যই।

বেশ কয়েকটা ছবি সে উঠিয়ে দিল।

বললাম তোমরা এসো আমাদের সাথে সেলফী করি।

সেন্ডী আর বারবারা থাকে রোড আইলেন্ডে। 

বললাম অনেক বার গিয়েছি ওখানে। নিউ পোর্টের পানির পাশ দিয়ে হেঁটেছি।

-আমরা থাকি প্রভীডেন্সে। বলল বারবারা।

-তুমি আর সেন্ডী দুজনে মিললে কি ভাবে? একটা বেঞ্চে বসে জিজ্ঞাসা করলাম ওকে। 

-একই স্কুলে কাজ করতাম আমরা দুজনে। অনেক অনেক অনেক বছর ধরে। দুজনেই হারালাম দুজনের সঙ্গিকে। তাও তো দশ বছর হয়ে গেলো। রিটায়ার করে এখন আমরা দুজনে একসাথে ঘুরে বেড়াই।

মনে হোল অনেক দিন পর সে পেয়েছে কাউকে  তার মনের খবর উজাড় করে দিতে।

-জানো সেই দিন টা ভুলতে পারিনা। বলে সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো।

আমিও ওকে সময় দিলাম। ওর মনের কথা এক অপরিচিত মানুষ কে বলতে চায়। হাল্কা হতে চায়।

দুরে সিডনি হারবারের শেষ প্রান্তের দিকে তাকিয়ে ছিল সে, আস্তে আস্তে আমার দিকে তাকালও।

-আমার ছেলের সাথে কথা বলছিলাম ফোনে। দরজায় টোকার শব্দে উঠে গেলাম।  দরজা খুলতেই দেখি দুই জন পুলিশ দাঁড়ানো। ভয় পেয়ে গেলাম। পুলিশ কেনও আমার দরজায়।

-তোমার স্বামীর নাম জন সেলবি। পুলিশ জিজ্ঞাসা করলো আমাকে।

-হ্যাঁ, বলতেই বলল, আমাদের সাথে তোমাকে হাসপাতালে যেতে হবে। তোমার স্বামী গাড়ী এক্সিডেন্ট করেছে।

আমি এলাম হাসপাতালে। ওকে নিয়ে গেছে অপারেটিং রুমে।

বসে রইলাম সারা রাত।

ওকে ওরা ফিরিয়ে আনতে পারলনা।

আমার চোখ দিয়ে একফোঁটা পানি বের হোল না। ও আমাকে বিদায় জানাতে পারলো না। আমি একা হয়ে গেলাম।

আমি ওর চোখে পানির রেখা দেখতে পেলাম।

-কি রে তোরা যাবিনা? সেন্ডী জোড়ে ডাক দিলো। ওদিকে ডানা অপেক্ষা করছে। বলে সেন্ডী আস্তে আস্তে এগিয়ে এলো আমাদের দিকে।

সবাই বাসে উঠে গেছে। শুধু আমরা তিন জন বাকি।

বাস পার্লামেন্ট হাউজ, সেন্ট মেরী ক্যাথিড্রাল, কুইন ভিক্টোরিয়া বিল্ডিং ঘুরে বাঁক নিলো ডানে।

অবশেষে  দি রক্স। ঐতিহাসিক এলাকা। প্রতিষ্ঠিত করেছিল আরথার ফিলিপস  তার convicts দের দিয়ে। আমাদের কেউ কেউ লোকাল শপ গুলো ঘুরে ঘুরে দেখল। দামদর করে পিছিয়ে এলো।

বাস দাড়িয়ে ছিল দুরে। হাটতে হাটতে আমরা এলাম বাসের কাছে।

সন্ধ্যায় ডিনার ক্রুজ। সিডনি হারবারে। জাহাজের নাম ক্যাপ্টেন কুক ক্রুজ। টেবিল রিজার্ভ ছিল আমাদের জন্য। ডিনার মেনুতে ছিল Barramundi fish filet, chicken cutlet, সালাদ। সব শেষে ভেনেলা চকলেট কেক।

দেড় ঘণ্টার ক্রুজ। জাহাজ টা চলছিল অপেরা হাউজের পাশ দিয়ে, বড় বড় নায়ক নায়িকা দের বাসার কোল ঘেঁষে। সময় পেড়িয়ে গেলো। আমরা ফিরে এলাম হোটেলে।

পরের দিন যাবো Blue Mountain দেখতে। ডানা বলে দিয়েছিল সকাল সাড়ে আটটায় যেন আমরা লবিতে থাকি।

সকালে নামতে একটু দেরী হয়ে গেলো। এসে দেখি সবাই নাস্তার রুমে এসে গেছে। রউফ কে বললাম, আজ বোধহয় অমলেট খাওয়া হোল না।

-আমি ওটা না খেয়ে যাবো না। বলে সে দাড়িয়ে রইল অর্ডার দেওয়ার জন্য।

না, খুব একটা দেরী হয়নি। প্রধান বাবুর্চি তাড়াতাড়ি বানিয়ে দিলো।

নাস্তা শেষে বাহিরে এসে দেখি আকাশ মুখ গোমড়া করে আছে।

লিলি পাশে এসে বলল, ক্রস ইওর ফিঙ্গার। যেন আকাশ পরিষ্কার হয়ে যায়। নচেৎ যাওয়াই বৃথা।

লিলি আর ক্যাথলিন এসেছে সানডিয়াগো থেকে।

বাস ছেড়ে দিলো ঠিক সাড়ে আটটায়।

যাবো Katoomba তে।

যাওয়ার পথে থামলাম Featherdale Wild Park এ। আছে কোয়ালাস, ক্যাঙ্গারু, পেঙ্গুইন, বিভিন্ন রং এর কাকাতোয়। ছোট্ট প্যাকেটে খাবার কিনে নিলাম ক্যাঙ্গারুকে খাওয়াবো বলে। ডানা বলে দিয়েছে বেশি সময় এখানে কাটানো যাবে না। কেননা যদি আকাশ মেঘে ঢেকে যায় তাহলে Blue Mountain এ যাওয়া টাই বৃথা।

আমরা সবাই এলাম গাড়ীতে, কিন্তু বিল আর ভীকী কোথায়? ওরা তো এসে পৌঁছায়নি। ফোন এখানে কাজ করে না। ডানা বাহিরে পায়চারি করছে। ১৫ মিনিট কেটে গেলো। ডেভিড বলল, আমি যেয়ে দেখি ওরা কোথায়।

ডানা রাজি হোল না।

কিছুক্ষণ পরে দুরে দেখা গেলো ওরা আসছে। হাসছে। বলল, কাকাতোয়া গুলো দেখেছ, কি সুন্দর। ওখানেই দেরী হয়ে গেলো। সরি।

দুরের আকাশ কালো। মাঝে মধ্যে বৃষ্টির ছিটে ফোঁটা পড়ছে গাড়ীর জানালায়। এখনো এক ঘণ্টার পথ। দুরে পাহাড় দেখা যায়। চলতে চলতে দেখতে পেলাম পাহাড়ের উপর আলোর রেখা। আমরা আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠলাম। ডানা বলল, এ পাহাড় সে পাহাড় নয়।

এসে পৌছালাম রৌদের ঝর্না নিয়ে। দুরের থেকে দেখলাম,  মনে হোল নীল ব্ল্যাঙ্কেট পাতা আছে তাই এর নাম দিয়েছে Blue Moumtain.

দুরের  পাহাড় নীলাভ রঙ দিয়ে কে যেন এঁকেছে। আকাশ নীল রঙে ছেয়ে আছে। প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্য। 

Echo Point থেকে দেখা Jamison Valley, The Three sisters এর অত্যাশ্চর্য দৃশ্য। 

দেখার কি শেষ আছে? ক্লান্ত হয়ে আমরা চারজন এসে বসলাম বেঞ্চে। হাটতে হাটতে এলো সফিয়া।

-কি ব্যাপার বসে কেন? পাহাড়ের নিচে নামোনি?

-নামতে তো পারবো, উঠতে পারবো তো? এই আশঙ্কায় আর যাওয়া হোল না। বলে বললাম, বসো।

ও এসে বসলো পাশে।

-ইব্রাহীম ভাই কোথায়? জিজ্ঞাসা করতেই বলল, সে নিচে গেছে, আমার হাঁটুতে ব্যাথা। তাই আর সাহস করলাম না।

-ভালো করেছো।

কিছুক্ষণ চুপ চুপ আমারা সবাই।

সফিয়া কি যেন ভাবছে মনে হোল। তাকালও আমার দিকে। বলল, জানো আমার ছেলে অনী এখানে আমাদেরকে নিয়ে আসতে চেয়েছিল। চেয়েছিল অস্ট্রেলিয়া দেখবে।  

-এবার তোমাদের সাথে আসতে পারেনি, পরে তোমাদেরকে নিয়ে আবার আসবে।

– না। সে আর হবার নয়। বলে তাকালও সামনে ঘুরঘুর করে ঘুরে বেড়ানো কবুতর গুলোর দিকে।

আমিও হতচ্ছাড়া, বলে বসলাম, তা হবার নয় কেন?

-সে চলে গেছে এই পৃথিবী ছেড়ে? বলে সজল নয়নে তাকালও আমার দিকে।

আমি আর কিছু তাকে জিজ্ঞাসা করিনি।

সেই বলেছিল, আমার ছেলে ছিল সোনার টুকরা। এখানেই জন্ম। সে ছিল valedictorian তার ক্লাসে। ডাক্তারি পড়তে গিয়েছিল। কার্ডিয়াক সার্জেন হয়ে যখন বের হোল, কত বড় বড় হসপিটাল থেকে ওর অফার এসেছিল। ও নেয়নি। পাছে আমাদের ছেড়ে বেশিদূর যেতে হয়। তাই মিশিগানের এক হসপিটালে চাকরি নিলো। ওখানেই পরিচয় হয়েছিল নাদিয়ার সাথে। সেও ডাক্তার। আমাদের সাথে পরিচয় করে দিয়েছিল।

ওর বাবা বলেছিল, এবার বিয়ে করে ফেল। আমাদেরও তো বয়স হয়েছে। 

বাঁধা আসেনি। ধুমধাম করে বিয়ে হোল।

দুই বছর পরে টুকটুকে একটা ছেলে এলো।

আমরা দাদা দাদি মিলে পালতাম। ওরা যেতো কাজে।

একদিন একটা অপারেশন শেষ করে বাসায় এসে সোজা শুতে চলে গেলো। আমি এলাম ওর ঘরে।

বললাম, বাবা, খাবি না? 

বলল, মাথা টা ভীষণ ধরেছে।

পীড়াপীড়ি করলাম না। ভাবলাম, খাটনি গেছে, তাই।

বৌমা এলো ঘণ্টা দেড়েক পরে। বললাম অনী তো শুয়ে পড়েছে মা, বলল মাথা ধরেছে।

-ওর ইদানিং প্রতিদিনই মাথা ধরছে। গত পরশু দিন তো বমিও করেছিল।

বললাম, তোমরা ডাক্তার, কেনও একটা মাথার MRI করছ না।

-আমি ওকে বলেছি, শুধু আজ না কাল করছে। কালই আমি এপয়েন্টমেন্ট নেবো। 

-MRI করেছিল? কেন যে জিজ্ঞাসা করতে গেলাম। নিজেকে নিজে গালাগালি করলাম।

-হ্যাঁ করেছিল।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো ওর বুক চিরে।

তাকাল নীল পাহাড়ের দিকে। আমিও চুপ করে রইলাম।

সফিয়া ফিরে এলো তার জগতে।

-টিউমার। ছোট নয়, বেশ বড়। আর মাথার এমন জাগায় যে অপারেশনও করা যাবে না।

সে ডাক্তার সে নিজেই জানে বেশিদিন তার হাতে সময় নেই। শুধু যাওয়ার আগে আমাকে আর ওর বাবা কে বলেছিল, তোমরা তোমাদের নাতি টাকে দেখো। আর আমিও বলেছি, তোমরাও বলও, নাদিয়া যেন আবার বিয়ে করে। ওর জীবনটা যেন নস্ট না হয়ে যায়।

আমি কেন জানি কেউ কাদলে কিছু বলতে পারিনা। আজও পারলাম না। সফিয়া কাঁদলও। এই জায়গায় তারা আসতে চেয়েছিল। অদৃষ্টের পরিহাস, এক সাথে আসা হোল না।

আস্তে আস্তে সবাই এলো বাসের কাছে। সফিয়া উঠে দাঁড়ালো। আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, এসো।

ইব্রাহীম ভাই এসে ওর হাতটা ধরল, বলল, যাওনি ভালো করেছ, ভীষণ খাড়া রাস্তা।

সকালে রওয়ানা দিলাম Qantas Airways এ করে মেলবোর্নের পথে। এক ঘণ্টা পয়ত্রিশ মিনিটের ফ্লাইট। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে নামলাম মেলবোর্নে। ঠাণ্ডা আর বাতাস। এমন তর হবে আশা করিনি। হোটেল চারটার আগে পাওয়া যাবে না। তাই ডানা ঘুরে ঘুরে দেখালও শহর টা। Melbourne Cricket Ground (MCG).

স্কুলে থাকা কালিন, রেডিও তে শুনতাম মেলবোর্নে খেলা হচ্ছে। পাকিস্তান বনাম অস্ট্রেলিয়া। হানীফ মোহাম্মদ ব্যাট করছে। আমরা গুলুর মতো আটকিয়ে থাকতাম রেডিও ঘিরে। আজ এতকাল পরে দেখতে পেলাম সেই জায়গা। সেই ক্রিকেট পিচ। মনে আনন্দ ধরে না।

অস্ট্রেলিয়ায় শেষ দিন। এক সাথে বসে আজ ডিনার করব সবাই। বিদায় দেবো ডানা কে। এতদিন সে ছিল আমাদের সাথে। আমাদের দেখাশোনার ভার ছিল তার উপর। আমরা সবাই কৃতজ্ঞ।

খাওয়ার টেবিলে সবাই ধরল ওর নিজের কথা বলতে।

কথার শুরু তে বললও, এই ট্যুর যখন বন্ধ থাকে, তখন আমি একটি কলেজে মাস্টারি করি। বন্ধু বান্ধবী দের সাথে বারে যাই। ড্রিংক করি। তেমনি এক বারে দেখা হয়েছিল অ্যান্থনির সাথে। ও বারটেন্ডার। সেদিন খাওয়ার মাত্রা টা একটু বেশি হয়েছিল। ও আমাকে গাড়ী চালিয়ে যেতে দেইনি। সে নিজে পৌছে দিয়েছিল আমার বাসায়।

তারপর প্রতিদিন যেতাম ওই বারে। বসতাম, ও গল্প করতো। বৌ এর সাথে ডিভোর্স হয়ে গেছে পাঁচ বছর হোল।

প্রতি রাতে আমি বসে থাকতাম। ওর ডিউটি শেষ হলে আমরা একসাথে হাটতে হাটতে এসে বসতাম কোন বেঞ্চে। ওর কেয়ারিং টা আমাকে আরও ওর  কাছে নিয়ে এলো।

এক রাতে আমাকে বাসায় পৌছে দিয়ে ও দাড়িয়ে রইল।

বললাম, কি ব্যাপার বাসায় যাবে না।

-যাবো, বলে সে আমার ঘরের দরজার সামনে হাঁটু গেরে বসে, একটা ছোট্ট বাক্স থেকে আংটি বের করে বলল, উইল ইউ মেরি মি?

আমি ওকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়ে বলেছিলাম, ইয়েস, আই উইল মেরি ইউ।

আমাদের একমাত্র মেয়ে আমেরিকার ডুক ইউনিভারসিটি থেকে গ্রাজুয়েট করে ফিরে এসেছে।

এত সুখের মাঝে উপরওয়ালা একটু যদি কল কাঠি না নাড়ে তবে সুখ টা কি তা তুমি বুঝবে কি করে।

তাই তো দুটো ব্রেস্ট ফেলে দিতে হোল। ক্যান্সারের বিষ ওখানে ঘোরাফেরা করছিলো।

 বেশ আছি। ছয় মাস পরপর শুধু চেক করতে হয়।

এই আমার কাহিনী।

আমারও তাই মনে হোল শুধু সুখই যদি থাকে জীবন ভর, তবে দুঃখ কি তা বুঝবে কি ভাবে।

এয়ারপোর্টে ডানা কে বিদায় দিয়ে আমরা প্লেনে উঠলাম। যাবো নিউজিল্যান্ড। 

Tasman sea পাড়ি দিয়ে Christ Church এ প্লেন পালটিয়ে আমরা এসে পৌছালাম Dunedin।

Karen দাড়িয়েছিল আমাদের কে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। নিউজিল্যান্ডে সে আমাদের গাইড।

Dunedin এ একদিন কাটিয়ে আমরা রওয়ানা দিলাম Queenstown এর দিকে। সকাল তখন নয়টা।

পথে লাঞ্চ করবো Clyde শহরে। Olivers Restaurant এ। চোখটা লেগে এসেছিল। শোয়েব ভাইয়ের ধাক্কায় ঘুমটা ভেঙে গেলো।

-কি হয়েছে?

-দুই চোখ খুলে দেখো চারিদিকে। কি অপূর্ব।

সত্যিই রাস্তার দুই দিকের সৌন্দর্য মুগ্ধ করল আমাকে। আঁকা বাঁকা রাস্তা। কখন অনেক নিচে নেমে গেছে। কখন অনেক উপরে উঠছে। দুরে সবুজ পাহাড়। তার মাঝে হলুদ ফুল। আল্লাহর সৃষ্টি। চোখ ভরে দেখো।

পাঁচ ঘণ্টা পার করে Queenstown এ ঢুকলাম। চোখ জুড়ানো দৃশ্য। পেঁজা পেঁজা সাদা মেঘ লুকোচুরি খেলছে পাহাড়ের সাথে। ছোট্ট নদী বয়ে চলেছে নিচে। আমরা এলাম হোটেল মিলিনিয়ামে।

মনে হচ্ছিল, অনেক দিন বাহিরে। ঘরটা আমার হাতছানি দিয়ে ডাকছে। নাতি বলছে আর কতদিন থাকবে দাদা। নাতনী ডাকছে, নানা ফিরে এসো।

আসব, Milford Sound টা দেখে নেই। যেখানে ঝরছে উচু পাহাড়ের গা বেয়ে ঝর্না। সাদা কালো মেঘ গুলো আছড়ে পড়ছে পাহাড়ের গায়ে। পাথরের উপর শুয়ে আছে তিনটি বাচ্চা Sea Lion। আমাদের বোটটা কাঁপছে ঢেউ এর তালে তালে।

বাচ্চা পেঙ্গুঈন দুটো ঝুপ করে ঝাপ দিলো পানিতে।

আমাদের বোঁট এসে ভিড়ল ঘাটে।

এবার ফেরার পালা। অকল্যান্ড হয়ে ফিরব আমরা যার যার গন্তব্য স্থানে। Pullman Auckland Hotel এ  ফেয়ারওয়েল ডিনার খেয়ে একে অপরের কাছ থেকে বিদায় চেয়ে নিলাম। চৌদ টা দিন আমরা কাটিয়েছি একসাথে। শুনেছি অনেকের জীবন কাহিনী। দেখেছি চোখের জল।

শুনেছি বিল তার ছেলেকে দেখে না দশ বছর হোল। দশ বছর হোল সে আসেনি বাবা কে দেখতে। কারন সে দেখতে চায় না তার সৎমা কে।

সব স্মৃতি গেঁথে নিলাম আমার হৃদয়ে।

প্লেনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছিলাম নিচের আকাশ টাকে। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠল আমার প্রিয় মুখ গুলো।

বলছে যেন, আমার জন্য কি এনেছ দাদা, আমার জন্য কি এনেছ নানা।

You may also like

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *