ওর সাথে দেখা হয়েছিল গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে। আমি ঢুকছিলাম আর সে বের হচ্ছিল। ধাক্কাটা অত জোড়ে লাগেনি। দোষ টা আমি বলব তার। কারন সে তাড়াহুড়া করে বের হচ্ছিল। আমি সরি বলতেই সে না তাকিয়ে, ওহো, ফটো শুট হচ্ছে, আমি বোধহয় বাদ পড়ে গেলাম। বলে দ্রুত দরজা পেড়িয়ে বাহিরে চলে গেলো।
কিসের ফটো শুট? আসার সময় কোন ফিল্মের শুটিং হচ্ছে এমন তো দেখলাম না।
ঘরে না ঢুকে বেড়িয়ে এলাম। বাহিরের লনে ফুলের গাছ। সেই খানে হলুদ শাড়ী, মাথায় হলুদ ফুল গুজে ছবি তুলছে মেয়েরা । এটাকেই সে বলে ছিল ফটো শুট।
-কিরে, তুই কতক্ষণ এসেছিস। বলে সামনে এসে দাঁড়াল আমার প্রিয় রুমাদি।
-এই তো এলাম, তা দেরী হলে তো এই শুটিং দেখা হতো না।
-যা না, তুই ওদের সাথে ছবি তোল। দাড়া আমি শিউলি কে ডাকছি। তোকে ওদের সাথে নিয়ে ছবি তুলতে।
-তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে। আমি চললাম ভিতরে, খিদে পেয়েছে। বলে ভিতরে চলে এলাম।
অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত এগারটা বেজে গেলো। উঠার প্রস্তুতি নিচ্ছি, এমন সময় রুমাদি এসে বলল, শোন কাল দুপুরে আমার বাসায় খাবি।
-তথাস্তু। বলে আমি বেড়িয়ে এলাম।
পরদিন রুমাদির বাসায় যেতে একটু দেরী হয়ে গেলো। ঘরে ঢুকতেই দেখি সেই ধাক্কা দেওয়া মেয়ে টা কথার খই ছড়াচ্ছে। আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবার মত্ত হয়ে গেলো কথার মাঝে। চেনা পরিচিত দুই একজন আছে আমার। তারা আমার কুশল জানতে চাইলো। আমি কথা বলতে বলতে টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলাম।
ছোট একটা প্লেটে দুটো কাবাব উঠাতে যাবো রুমাদি এসে দাঁড়ালো আমার পাশে।
-এই শিউলি, এদিকে আয়। বলে ডাক দিল।
-কি হয়েছে এত চিল্লাচ্ছ কেন? বলে ধাক্কা দেওয়া মেয়ে টা এসে দাঁড়ালো পাশে।
-চিল্লাচ্ছি কারন আমার এই ছোট ভাই এর সাথে তোর পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য। ওর নাম শমিত। তুই না বলিস,
নিউইয়র্কের কোন কিছুই আজ পর্যন্ত দেখা হয়নি। এই শমিতই তোকে নিয়ে যাবে। তোর যেমন
ফটো তোলার বাতিক, ওর বাতিক হচ্ছে ফটো উঠানোর।
এই যে মশাই, এর নাম শিউলি। থাকে টেনেশিতে। এবার তোমরা কথা বলও। বলে রুমাদি চলে গেলো রান্না
ঘরের দিকে।
-তা আপনি আমাকে কবে নিয়ে যাবেন নিউইয়র্ক শহর টা দেখাতে?
-তা আপনার যেদিন সুবিধা। চলুন কাল সকালে বেড়িয়ে পড়ি। বলে ওর উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম।
-কালই? দুই এক দিন পরে গেলে হয়না। বলে সে আমার দিকে এমন ভাবে চাইল যে মনে হোল আমাকে রাগাতে
চাইছে।
আমার মেজাজ টা একটু তিরিক্ষি হয়ে গেলো, বললাম, গরজ টা আপনার আমার নয়। যেদিন যেতে চান, রুমাদির
কাছে আমার নাম্বার আছে, কল করবেন। যদি সেদিন ব্যস্ত না থাকি তবে নিয়ে যাবো।
এই কথা বলে আমি রান্না ঘরে রুমাদির কাছে যেয়ে বসলাম। সেও এলো আমার পিছন পিছন।
গলার স্বর মোলায়েম করে বলল, আপনি রাগ করছেন। আমি ঠাট্টা করছিলাম। আপনি যেদিন বলবেন সেদিনই
যাবো।
রুমাদি থাকিয়ে দেখল আমাদের দুজন কে। তারপর হেসে বলল, কিরে পরিচয় হতে না হতেই ঝগড়া আরম্ভ হয়ে
গেছে।
-তোমার ছোট ভাই এর সহন শক্তি একটু কম। একটু ঠাট্টা করে কিছু বললাম তো রেগে বাঘ। বলে হাসতে থাকল।
–কাল সকাল দশ টায় রেডি থাকবেন। বলে গরম গরম ভাজা ডালপুরি একটা উঠিয়ে নিলাম পাত্র থেকে।
আড্ডা টা জমে উঠেছিল। মুক্তার ভাই জমিয়ে রেখেছিল। বাসাটা মুক্তারভাই আর রুমাদির।
আমার সাথে তাদের পরিচয় অনেক অনেক আগের। ছোট বেলায় একই পাড়ায় থাকতাম। আমার বয়স তখন দশ।
আমাদের বাসার পিছনের বাসায় রুমাদিরা থাকতো। রুমাদির বাবা পুলিশে চাকরি করে। আমার আসা যাওয়া ছিল ঐ
বাসাতে। ওখানে গেলেই রুমাদি আমার হাতে একটা চিঠি দিয়ে বলতো, একটা কাজ করে দিবি, এই চিঠি টা মুক্তার
ভাইকে দিয়ে আসতে পারবি?
-কোথায় পাবো তাকে?
-রাস্তার শেষ মাথায় যে গাছটা আছে, ওর নিচে দাড়িয়ে আছে। যাবি লক্ষীটি।
কেন জানি রুমাদির কথা আমি ফেলতে পারতাম না।
অনেক দিন ধরে এই চিঠি আদান প্রদান আমি করেছি। আমি ওদের দুজনের মাঝে সেতুর মত।
একদিন স্কুল শেষে ঐ বাড়ীতে যেয়ে থমকে গেলাম। থমথমে ভাব। রুমাদিকে কোথাও দেখলাম না।
সাহানা আমাকে ডেকে নিয়ে এলো এক কোণে। ও আর আমি একই ক্লাসে পড়ি।
বলল, আপা বাড়ীতে নেই। মুক্তার ভাই এর সাথে কোথায় যেন চলে গেছে।
কেন? এসব আমার মাথায় তখনো ঢোকেনি।
পরে শুনেছি রুমাদির বাবা রাজি ছিলনা মুক্তার ভাই এর হাতে রুমাদিকে তুলে দিতে।
তারপর আমি বড় হলাম। সেই শহর ছেড়ে আরও বড় শহরে এলাম। একদিন সেই বড় শহর ছেড়ে
সাত সমুদ্র তেরো নদী পেড়িয়ে এলাম এই দেশে।
রুমাদির সাথে এদেশে দেখা হওয়া টাও বলা যেতে পারে এক আশ্চর্য ঘটনা।
শিল্পাঙ্গনের অনুষ্ঠান। আমি বাহিরে আড্ডা দিচ্ছিলাম।
শুনতে পেলাম অনুষ্ঠানের পরিচালক বলছে,
-আপনারা সবাই বসুন, যারা বাহিরে দাড়িয়ে আছেন তাদের কে অনুরোধ করব যার যার আসন নিয়ে বসতে।
আমাদের অনুষ্ঠান আরম্ভ হচ্ছে।
আমি ভিতরে ঢুকতে যাবো, নাম ধরে মেয়েলি গলায় কে যেন
ডাকল।
পিছন ফিরে তাকালাম, তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।
-চিনতে পারছিস? আমি তোকে এক দেখায় চিনতে পেরেছি।
-রুমাদি? তুমি?
– হ্যাঁ, আমি। তুই একটুও পাল্টাসনি, শুধু গোঁফ টা ছাড়া।
রুমাদি আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোকে আমি ভুলিনি ভাই।
ঠিক দশটায় আমি হাজির রুমাদির বাসাতে। সেখানেই তার থাকার কথা। রুমাদি বোধহয় আমার সময় জ্ঞানটা ওকে বলে রেখেছিল। তাই আমি যেতেই সে নেমে এলো উপর থেকে। জিনসের প্যান্টের উপর হলুদ রং এর কামিজ।
মানিয়েছে। পড়তে যাচ্ছিল ফ্যান্সি জুতো।
বললাম, ওটা চলবে না। হাটতে হবে অনেক। সিনিকার হলে ভালো হয়।
– সিনিকারে ছবি ভালো আসবে না। খ্যাত খ্যাত লাগবে।
-এ বাংলা শেখালো কে? ভেবে ছিলাম আপনি বুঝি——-
কথা শেষ না হতেই দুচোখ বড় করে আমার চোখের দিকে চেয়ে বলল, কেন ভাষা শুধু আপনিই জানেন আমরা জানি না?
আরও কথার পিঠে কথা হয়তো চলতো, রুমাদি এসে থামাল।
-তোরা শুধু ঝগড়াই করবি?
-এতো ঝগড়া নয় রুমাদি একে অপরকে জানা। বলে শিউলির দিকে তাকিয়ে বললাম, চলেন, দেরী হয়ে যাচ্ছে।
সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। তাপের উষ্ণতা কম।
বাহিরের লনে অনেক গোলাপের গাছ। কয়েকটা মৌমাছি গুনগুণ করে ডেকে বেড়াচ্ছে গোলাপের পাশে।
-আমি এই গোলাপ ফুল নিয়ে ছবি তুলবো। বলে দুটো গাছের মাঝে বসল সে।
রুমাদি তো বলেই ছিল তার বাতিকের কথা। অতএব একটা নয় বেশ কয়েকটা ছবি তুলতে হোল। বিভিন্ন ভঙ্গিতে।
গাড়ী তে উঠে আমাদের আজকের পরিকল্পনা টা বললাম। উল্লসিত হয়ে সে আমার ডান হাত টা চেপে ধরল।
আমি ছাড়িয়ে নেই নি এই ভেবে যে ও ওর আনন্দটা প্রকাশ করছে। বাঁধা দিলে আনন্দ টা মাটি হয়ে যাবে।
-ও সরি।
-সরি হওয়ার কিছু নেই, আমরা দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক। বলে পকেটে রাখা ট্রাইডেন্ট গাম টা এগিয়ে দিলাম।
আসার আগে রুমাদি পাশে ডেকে বলেছিল, আজ হবে তোমার ধৈর্যের পরীক্ষা। ফিরে এসে সব বলবে আমাকে
কোন কিছু সেন্সর করে নয়।
-কেন সেন্সর করার মত কিছু হবে বলে তোমার মনে হয়।
-কি জানি দুজনেই ব্যাচেলার কিনা। বলে দুটো পানির বোতল আমার ব্যাগপেকে ঢুকিয়ে দিয়েছিল।
সাবওয়েতে সে চড়েনি আগে। কাজেই এটা তার কাছে একটা নতুন অভিজ্ঞতা।
টিকিট কাটতে যাবো, সে তার পার্স থেকে টাকা বের করে আমাকে দিতে চাইল।
বললাম, আজ আপনি আমার গেস্ট। কাজেই সব ব্যয় আজ আমার।
সে না করলো না। শুধু বলল, এই আপনি আপনি বলা টা বড় কানে লাগছে। তুমি বলে যদি সম্বোধন করি তবে
কি রাগ করবেন। তাছাড়া আপনি আমার থেকে এমন কিছু বয়সে বড় বলে মনে হচ্ছে না। কত? পাঁচ ছয় বছরের
বড় হবেন হয়তো। তাই না?
আমি উত্তর দেবার আগেই আমার হাত টা ধরে টেনে নিয়ে এলো প্লাটফর্মের ধারে।
-ঐ দেখো ট্রেনটা আসছে, এখান থেকে আমার একটা ছবি নাও ট্রেন টা কে নিয়ে।
-অত ধারে যেও না পড়ে যাবে। আমার বুকটা ধক করে উঠল।
-তাড়াতাড়ি নাও।
নিয়েছিলাম, রেগে বলেছিলাম, এই রকম ছেলেমানুষি করবে না।
-এই দেখো, তোমার এই তুমি ডাকটা আমার খুব ভালো লাগছে।
ট্রেন টা এসে দাঁড়ালো। ভিড় কম। দুজনে পাশাপাশি বসলাম।
-একটা সেলফী উঠাও আমার আর তোমার। বলে ব্যাগ থেকে লিপস্টিক বের করে আলতো ভাবে ঠোঁটে ছুঁইয়ে নিলো।
আপত্তি করতেই, বলে উঠলো, ওহ, তোমার গার্লফ্রেন্ড দেখলে একচোট নেবে তোমাকে, তাই?
-এখনো কপালে জোটে নি। কাজেই ঐ ভয় নেই।
প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ। নামব বলিং গ্রীন ষ্টেশনে। সেখান থেকে দেখবো স্ট্যাচু অফ লিবার্টি। দুর থেকে দেখব, তাই ভেবেছিলাম। তা আর হয়নি। ফেরী করে যেতে হোল স্ট্যাচু অফ লিবার্টি কাছে। আমার ক্যামেরায় ছবি তুলল সে বিভিন্ন ভঙ্গিতে। কখনও বসে, কখনও দাড়িয়ে, কখন হাওয়ায় চুল উড়িয়ে।
বসলাম গাছের তলায়। বারগার খেয়ে কাটিয়ে দিলাম দুপুর টা।
সেখানেই কি শেষ? ফ্রীডম টাওয়ার থেকে টাইম স্কয়ার। টাইম স্কয়ারের চত্বরে যখন দুজনে দুটো কফি নিয়ে বসলাম তখন সূর্য ঢলে পড়েছে। নিয়ন সাইনের আলোয় ঝলমল করছে চারিদিক।
দুজনেই ক্লান্ত।
-আমার হাতটা ধরে বলল, জানো, কতবার এসেছি নিউইয়র্কে কেউ আমাকে নিয়ে আসেনি, তুমিই নিয়ে এলে। তোমার সাথে দেখা না হলে এটাও দেখা হতো না।
কথা বলতে বলতে জিজ্ঞাসা করলাম, রুমাদির সাথে তোমার পরিচয় কীভাবে।
-সে এক ইতিহাস। শুনতে চাও?
-তোমার আপত্তি না থাকলে।
-শোন, আমরা তখন থাকি মিশিগানে। বাবা ডাক্তার, মা নার্স। বুঝতেই পারছ কম্বিনেশন টা। মা র কাছে শুনেছি
ওদের ছিল প্রেমের বিয়ে। যে মহল্লায় আমরা থাকতাম, সেখানে কটা বাঙালির মাঝে আঙ্কেল আর অ্যান্টিও ছিল।
কিভাবে যেন মা র সাথে অ্যান্টির খুব ভাব হয়ে গেলো। আমার তখন বয়স ছয়। একদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে দেখি
মা শুয়ে আছে। চোখ দুটো লাল। কাছে আসতেই আমাকে জড়িয়ে ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো।
আমার ছোট্ট মাথায় কিছুই ঢুকল না।
-কি হয়েছে, শরীর খারাপ? বলে আমি মার আঁচল দিয়ে মার চোখ টা মুছিয়ে দিলাম।
সেই রাতে বাবাকে বাড়ীতে দেখলাম না। ভাবলাম, কাজের চাপে হসপিটালে রয়ে গেছে। পরদিনও বাবা এলো না।
এলো অ্যান্টি। আমাকে নিয়ে এলো খাবার ঘরে। যত্ন করে খাইয়ে দিলো।
বেশ কিছুদিন পরে বাবা এলো। শরীরের চারিদিকে নল লাগানো। উপরে একটা পানির থলে। আমি কিছুই বুজতে পারলাম না। একদিন অ্যান্টি আমাকে স্কুল থেকে নিয়ে এলো সকাল সকাল। বাসায় এসে দেখলাম অনেক লোক ড্রয়াইং রুমে বসা। মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোর বাবা চলে গেছে। আর ফিরবে না। দেখলাম বাবা শুয়ে আছে, চোখ দুটো বন্ধ। এরপর অ্যান্টি প্রতিদিন আসতো। আমার দেখাশুনা অ্যান্টিই করতো। আমার কপালে যে আরও দুর্ভোগ আছে তা কে জানতো। মাস ছয়েকের মাথায় মা ও চলে গেলো গাড়ী এক্সিডেন্টে।
তারপর অ্যান্টি নিয়ে এসেছিল ওদের বাসায়। আঙ্কেল আর অ্যান্টি মিলেই আমাকে মানুষ করেছে। আমি আজ ওদের মেয়ে।
মিশিগান থেকে ওরা চলে এলো নিউইয়র্কে আর আমি চাকরি নিয়ে চলে গেলাম টেনেশিতে। বলে থামল।
আমি ওর দুই চোখ বেয়ে জলের ধারা দেখতে পেলাম।
চলো উঠি।
ট্রেনে বসে ও বলল আমি তোমার ঘাড়ে মাথা রাখতে পাড়ি? বড় ক্লান্ত লাগছে।
আমি না করিনি।
দুদিন পরে, বিয়ের ডামাডোল। সবাই সাঁজতে ব্যস্ত। শিউলি পড়লো শাড়ী। গাড় মেরুনের উপর সোনালী কাজ। চওড়া পাড়।
সুন্দর দেখাচ্ছিল ওকে।
বিরাট হলঘর। একই টেবিলে আমি রুমাদি, মুক্তার ভাই আর শিউলির সাথে অন্যান্যরা। বর, কণে এসে গেছে। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলছে। শিউলি উঠে এলো, চলো আমার কয়েকটা ছবি উঠিয়ে দেবে।
অগত্যা আমাকে উঠতে হোল।
শিউলি মিশে গেলো ওদের সাথে। আমি ছবি তুললাম, কথা বললাম অন্যদের সাথে।
ঘাড়ে হাত পড়লো, ফিরে তাকিয়ে দেখি শ্রাবণী।
-আমার ছবি উঠাবে না? বলে হাসল।
-কবে ফিরলে লন্ডন থেকে।
-গত পরশু। জানতাম তোমার সাথে দেখা হবে এখানে। কেমন আছো?
-এজ ইউজুয়াল।
-আমার কথা মনে পড়ে তোমার?
-পড়ে, তবে আগের মত অত বেশি নয়।
-সেটাই স্বাভাবিক। পেয়েছ কি কাউকে?
-খুঁজিনি।
-তুমি?
-পেয়েছি, ওদেশী।
-কংগ্রাট।
এক সময় আমি আর শ্রাবণী ঘুরেছি এক সাথে। ও সুন্দরী, স্মার্ট তবুও কোথায় যেন একটা কিন্তু রয়ে যায়। সেও বুঝেছিল। তাইতো একদিন বলেছিল, আমাদের মাঝে বন্ধুত্ব টাই বড় হোক, গাঁটছড়া নাই বা বাধলাম, কি বলও?
তুমি এখানে? আমি তোমাকে খুজে বেড়াচ্ছি। বলে শিউলি তাকালও শ্রাবণীর দিকে।
-পরিচয় করিয়ে দেই। শ্রাবণী, আমার বান্ধবী, থাকে লন্ডনে।
আমি কিছু বলার আগেই সে শ্রাবণীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমি শিউলি, থাকি টেনেশিতে।
তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি তো ব্যস্ত। ঠিক আছে, বলে চলে গেলো।
শ্রাবণী কাঁধে হাত দিয়ে বলল, যাও, আমি আছি কিছুদিন।
অনুষ্ঠানের প্রধান পরিচালক ঘোষণা করছে যার যার জাগায় গিয়ে বসতে। এখনি অনুষ্ঠান শুরু হবে।
আমি শিউলি কে খুজলাম যেখানে ভিড় সেখানে, পেলাম না। ফিরে এলাম আমার টেবিলে, দেখি সেখানে সে বসে।
মুচকি হেসে বলল, তোমার বান্ধবী দেখতে মিষ্টি।
আমি হাসলাম।
সব অনুষ্ঠান শেষ। এবার শিউলির ফেরার পালা। কেন জানি বুকের মাঝে ফাকা ফাকা লাগছে। আমাকেই নিয়ে যেতে হবে এয়ারপোর্টে।
সুটকেস দুটো গাড়ীতে উঠিয়ে নিলাম। ও এসে বসলো।
আমি আমার পাশে রাখা এ্যালবাম টা ওর হাতে দিয়ে বললাম, তোমার আমার স্মৃতি রইল এই এ্যালবামের মাঝে।
আমার দিকে তাকালও সে। বলল, কবে আসবে আমাকে দেখতে।
দিন যায়, ক্ষণ যায়। ফোনে কথা হয়। সময় বয়ে যায়।
একদিন আর ফোন বাজলো না। আমি ফোন করলাম সে ধরলও না।
রুমাদি কে জিজ্ঞাসা করলাম। সে আমার প্রশ্ন এড়িয়ে যেয়ে অন্য কথা বলতে আরম্ভ করলো। চোখে জল।
ঠিক করলাম টেনেশিতে যাবো।
পৌছালাম সন্ধ্যায়। দরজায় টোকা দিতে দরজা খুলে যে মেয়ে টা দাঁড়াল তার কথা আমি শুনেছি ওর কাছে। ওর রুমমেট।
দরজা থেকে সরে দাঁড়াল সে।
আমি ভিতরে গেলাম। ও নিয়ে গেলো শিউলির ঘরে। পরিপাটি করে বিছানা সাজানো। মাথার কাছে এ্যালবামটা।
-কোথায় সে? কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞাসা করলাম।
-আছে সে, তবে যেখানে আছে সেখানে আমি তোমাকে নিয়ে যাবো না। ও তোমার সইবে না। তুমি তাকে চিনতে পারবে না। সেও তোমাকে চিনতে পারবে না। সে কিছুই বলে যেতে পারলো না। বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।
-বলও, কি হয়েছিল? আমি জানতে চাইলাম।
-স্ট্রোক।
অনেক কথার পর সে আমাকে নিয়ে গেলো সেই নার্সিং হোমে।
আমি দেখলাম। ওর শরীরের চারিদিকে নল লাগানো।
এ- কোন শিউলি।
আমি পাশে বসলাম। হাত টা হাতে নিলাম। সে জানতেও পারলো না আমি এসেছিলাম।