স্বপ্নভঙ্গ

   অনেক অনেক দিন পরে  রুমার সাথে দেখা হোল গৌরীর এক আত্মীয়র বাসায়। তখন আমার পড়ন্ত যৌবন। সে ও পিছিয়ে নেই। বয়স বেড়েই চলেছে বেহায়ার মত। রুমার সেই দেমাগি চেহারা টা আজ আর নেই। যেটা আমি দেখে ছিলাম ওর যৌবন কালে। তার সেই মসৃন সাদা চামড়ার উপর কে যেন লেপটে দিয়েছে একরাশ কালো কালি।

সে অহংকার করতো তার চেহারা নিয়ে। আজ তা বিলুপ্ত। দামী সালোয়ার কামিজ পড়ে বের হতো সে।

আজ পড়নের শাড়ীটা নিতান্তই আটপৌরে। তার সেই অহমিকা আজ আর আমি দেখতে পেলাম না তার চেহারায়।

সে নিজেই এগিয়ে এলো। চোখ তুলে তাকালও আমার দিকে। চোখের নিচটা কালচে হয়ে গেছে।

-চিনতে পারছেন? বলে আরও কাছে এগিয়ে এলো সে।

-অসুবিধা হয়নি তোমাকে চিনতে। কিছুটা পাল্টিয়েছ।

-অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আজ এখানে এসে দাঁড়িয়েছি, চঞ্চল দা। যাক সে সব কথা। গৌরী কোথায়?

-ভিতরে।

গৌরী আর সে পড়তো একই স্কুলে, একই শ্রেণীতে।  গৌরীর বাসায় যাতায়েত ছিল আমার। গৌরীই বলেছিল আমাকে, জানো ও ভীষণ দাম্ভীক। সুন্দরী তো,  একটু গান জানে তাই ধরাকে সরা জ্ঞান করে। কি বলেছিল সেদিন জানো?

আমি গৌরীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কি বলেছিল?

বলেছিল সে অনেক বড়লোকের ছেলে কে বিয়ে করবে। গাড়ী চালিয়ে যখন সে যাবে তখন পথের ধুলা এসে পড়বে আমাদের গায়ে।

-তা স্বপ্ন দেখতে দোষ কি? বলেছিলাম।

গৌরী ভ্রু কুচকিয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিল।

এখানে বলে রাখি, গৌরী আর আমার মাঝে প্রেম, ভালবাসা বলে কিছু হয়নি তখনো। পাশের বাড়ী, তাই যাওয়া আসা ছিল। কাহিনী আজ আমাকে নিয়ে নয়, রুমাকে নিয়ে।

বাবা মার এক আদুরে মেয়ে। ভাই ছিল ওর ছোট। বাবার টাকা পয়সার অভাব ছিল না। মেয়ে যা চেয়েছে তাই কিনে দিয়েছে। তার বদ্ধমূল ধারনা, সে দেখতে সুন্দরী। আয়নার সামনে দাড়িয়ে থাকতো অনেক সময় নিয়ে। ( অবশ্য শোনা কথা)

বাবাকে বলেছিল সে গান শিখবে। বাবা গানের মাস্টার রেখেছিল। তবে বেশিদিন টেকেনি। দুই একটা গান গাইতে শিখেই সে ভেবেছিল আর দরকার নেই। এবার স্টেজে গাইবে।

সেই দিনটিও এলো।

 আমাদের ছোট্ট শহরটি সাংস্কৃতিক দিক দিয়েছিল অনেক উন্নত মানের। রাজনীতি নিয়ে মারামারি কাটাকাটি নেই।

ছিল সাংস্কৃতিক সংঘ । শিল্পী সংঘ। গান নাচ শেখানো হতো।

সেই সংঘের এক অনুষ্ঠানে গান গাইল সে। লোকে হাততালি দিয়েছিল। ওতেই ওর মাথাটা আরও বিগড়ে গেলো।

সে নিজেকে উচু দরের শিল্পী মনে করতে আরম্ভ করলো।

স্বপন দা তাকে বলেছিল, তোমার এখনো গান শেখা হয়নি। অনেক কিছু শেখার আছে।

 হারমোনিয়াম বাজিয়ে প্রতিদিন কাজের পরে রেওয়াজ করতে হবে। সে শোনেনি সে কথা। প্রতি অনুষ্ঠানে একই গান গাইত। আস্তে আস্তে মাস যেয়ে বছর পাড় হোল। আমি তখন ঐ শহর ছেড়ে চলে এসেছি রাজধানী তে।

হঠাৎ একদিন দেখা নিউ মার্কেটে।

-এই যে চঞ্চল  দা, এদিকে তাকান।

একটু জোর গলায় ডেকেছিল সে।

তাকালাম।

– রুমা। কবে থেকে এই শহরে? বলতেই পরিচয় করিয়ে দিলো পাশে দাঁড়ানো ভদ্রলোকের সাথে।

-দুই বছর হয়ে গেলো। আপনার তো জানার কথা। গৌরীর সাথে তো আমার প্রায় দেখা হয়।

-হয়তো ভুলে গেছে। তা তোমার গান বাজনা কেমন চলছে।

-ছেড়ে দিয়েছি। বড় বাজে দর্শক। হাততালি না দিয়ে শিটি মারে। ওসবের মধ্যে আমি আর নেই। রিয়াজ আর আমি অন্য কিছু চিন্তা করছি।

-অন্যকিছু মানে? অবাক হয়ে তাকালাম ওর দিকে।

-আর একদিন বলব, আজ চলি। বলে রিক্সায় ওরা দুজন উঠে বসলো।

ভদ্রলোক কে দেখে বয়স্ক মনে হোল।

এরপর সব শুনেছিলাম গৌরীর কাছ থেকে।

রিয়াজ এসেছিল ওর ভাগ্নী কে হোস্টেলে নামাতে। সেখানেই দেখা ওর সাথে। 

সেদিন বাহিরে এসে কোন রিক্সা দেখতে পেলো না রুমা।

রিয়াজ এগিয়ে এসে বলেছিল, রিক্সা খুজছেন, এই সময়ে পাবেন না। কোন দিকে যাবেন?

-উনিশ নম্বর রোডে।

-আসুন আমি নামিয়ে দেবো। আমি ওদিকেই যাবো। যদি আপনার কোন আপত্তি না থেকে এক সাথে রিক্সায় উঠতে।  আমার পরিচয় দেই, আমি রওশোন আরার মামা।

সেদিন সে আপত্তি করে নি।

ওদের বয়সের ব্যবধান ছিল বিশ বছরের। রিয়াজ বলেছিল, সে এক বিরাট কোম্পানির ম্যানেজার।  বাবা মা থাকে বগুরায়। সে থাকে গুলশানে।

কোনদিনই সে তার গুলশানের ফ্লাটে নিয়ে যায় নি।

স্যুইট টকার রিয়াজ কে সে চিনতে ভুল করেছিল। জানতে চায়নি অন্যকিছু। 

বাবা মা কে জানিয়েছিল সে বিয়ে করতে চলেছে রিয়াজ কে।

ওরা সব শুনে বলেছিল, এ ভুল করিস নে মা। তোর চেয়ে বিশ বছরের বড়। ও যা বলেছে সব বিশ্বাস করলি তুই? খোঁজ নিয়েছিলি?

জবাবে বলেছিল, জানতে চাই না। ও আমাকে ভালবাসে। ও বলেছে, বিয়ের পর ও আমাকে নিয়ে আরও বড় একটা ফ্ল্যাটে উঠে যাবে। ওর  টাকা পয়সার তো কমতি নেই।

মা বাবা ওকে ঠেকাতে পারেনি।

ও বিয়ে করেছিল। রিয়াজ গুলশানের ঐ ফ্লাটে ওকে উঠায় নি। ছোট্ট একটা বাসা ভাড়া নিয়েছিল টিকাটুলি তে। দুই পাশে বেড়া, উপরে টিনের ছাদ।

কতবার রুমা বলেছিল, তোমার ঐ গুলশানের ফ্লাট কি হোল?

উত্তরে রিয়াজ বলেছিল, আমার বস কিছুদিন থাকবে ওখানে। চটাতে তো পারিনা। হাজার হলেও বস।

রুমা কিছু বলে নি।

মাঝে মাঝে রিয়াজ বাসায় ফেরে না। জিজ্ঞাসা করলে সঠিক উত্তর দেয় না। কোথায় যেন একটা গড়মিল আছে মনে হয় রুমার কাছে।  একদিন অনেক রাতে রিয়াজ  বাসায় আসতেই রুমা বলেছিল সে অন্তঃসত্বা। রিয়াজ ভালো মন্দ কিছুই বলে নি। সেদিন রুমা অনেক কেঁদেছিল।

দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে রান্না ঘর থেকে বেরিয়ে এলো রুমা। শরীর টা আজ বড় ম্যাজম্যাজ করছে। দুইবার বমি হয়েছে। রিয়াজ বেরিয়ে গেছে সেই সাত সকালে।

দরজা খুলে দেখল এক ভদ্রমহিলা দাঁড়ানো।

-কাকে চাই। জানতে চাইল রুমা।

-এটা কি রিয়াজের বাসা?

-হ্যা, ও বাসায় নেই। ওকে কিছু বলতে হবে?

-ওকে বলবেন ওর বৌ এসেছিল।

-মানে? রুমার মাথাটা টলে উঠল।

-মানে, আমি ওর বিয়ে করা বৌ। নাম শিউলি।  গত দুইদিন আগেও তো সে আমাকে কিছু বলে নি। দুজনে মিলে সিনেমা দেখলাম। আজ যদি সবীরের মা না বলতো তবে তো কোনদিনও জানতাম না সে আমার সতীন নিয়ে ঘর করছে।

দরজা খোলা রেখেই রুমা এসে বসলো একটা চেয়ারে। শিউলি ভিতরে এলো। চেয়ার টেনে বসলো পাশে।

-কতদিন হয়েছে ঐ বদমাইশ টা তোমাকে বিয়ে করেছে।

-দেড় বছর।

-দেড় বছর? আমাকে বলে কিনা সে অফিসের কাজে বাহিরে যায়। গজরাতে থাকলো শিউলি।

-কোথায় থাকেন। জানতে চাইলো রুমা।

-মোহাম্মদপুর।

-গুলশানের ফ্লাটে থাকেন না?

-গুলশানের ফ্লাট? তুমি কি স্বপ্ন দেখছ? ও বলেছে ওর ওখানে ফ্লাট আছে? হারামজাদা। ওর আমি গলা কেটে ফেলব।

রুমা কোন কথা বলতে পারেনি। আবারও বমির ভাব এলো। দৌড়ে চলে গেলো বাথরুমে। সেখান থেকে সে বের হয়নি যতক্ষণ না শিউলি চলে না যায়।

নাওয়া নেই খাওয়া নেই। বসে ছিল চেয়ার টা তে। চারিপাশে সব অন্ধকার হয়ে আসছে।

পাশের বাড়ীর মনিরার মা এসেছিল। ওকে বলেছিল সব কথা।

মনিরার মা  সেদিন রান্না করে দিয়েছিল। চুল বেঁধে দিয়েছিল।

সন্ধ্যায় রিয়াজ এলো।

-অন্ধকার কেনও। লোডশেডিং নাকি? বলে বাহিরে রাখা গামছা নিতে যাবে তখনি রুমা বলল,

-শিউলি এসেছিল। 

চমকে উঠলো রিয়াজ। তাকালও যে দিক থেকে কথা টা এসেছিল সেই দিকে।

দেখতে পেলো আবছা অন্ধকারে দাড়িয়ে আছে রুমা। সুইচ টা অন করতেই রুমার  অগ্নিঝরা চেহারা টা দেখতে পেলো রিয়াজ।

-আমার জীবন টা কেন তুমি শেষ করলে। আমি তো তোমাকে ভালোবেসে ছিলাম। এই তার প্রতিদান, অসভ্য, নির্লজ্জ, ইতর। বেরিয়ে যাও এখান থেকে। থরথর করে কাঁপছে রুমা।

মনে পড়লো বাবা,মা নিষেধ করেছিল। সবার কথা উপেক্ষা করে সে বেরিয়ে পড়েছিল এই লোকটার সাথে।  অনেক বড় বাড়ীতে থাকবে। গাড়ী চালাবে। চাকর বাকর থাকবে। এই না চেয়ে ছিল সে।

তাই তো কলেজের ডিগ্রী তার নেওয়া হয়নি।

আজ সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। ঘরে ঢুকে দরজা টা বন্ধ করে দিলো।

এরপরের ঘটনা খুবই সংক্ষিপ্ত। চলে এসেছিল সেই ছোট্ট শহরে। বিচ্ছেদ নিয়ে ছিল রিয়াজের থেকে। বাবা, মা যতদিন বেচে ছিল ওরাই দেখা শোনা করেছে। ছেলে টা বড় না হতেই বাবা মা কে হারালও সে। জমি জমা কিছু পেয়েছিল বাপের কাছ থেকে। সংসার চালাতে যেয়ে সেগুলোও বিক্রি করে দিলো।

আজ তার টানা পড়নের সংসার।

-এই শুনছো।

আমি তাকালাম গৌরীর দিকে।

-এদিকে এসো। কথা আছে।

আমি এগিয়ে এলাম।

ও কানের কাছে ফিসফিস করে বলল, তোমার কাছে কি কিছু টাকা হবে?

-হবে।

-তাহলে দাও।

আমি সব টাকা ওর হাতে উঠিয়ে দিলাম।

ও ভিতরে চলে গেলো।

  1.  

You may also like

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *