সন্ধ্যা তাঁরা

                          

রাত বারোটা। কেবল চোখ টা বুজে এসেছিল। টুং করে শব্দ হোল ফোন টা তে। ম্যাসেজ এসেছে। ঘুমানোর আগে আমি ওটাকে সাইলেন্টে দিয়ে রাখি। আজ ভুলে গিয়েছিলাম। তারই খেসারত দিতে হোল। সামন্তী পাঠিয়েছে ম্যাসেজ টা। লিখেছে , তুমি ঘুমাও নি আমি জানি। তাই সরি বলছি না। এখনি আমাকে কল করো, জরুরী কথা আছে।

ও মনে করে আমার উপর তার অধিকারের সীমা নেই। যখন তখন কোন খবর না দিয়েই চলে আসবে। বাসায় আমি আছি কি না আছি তার তোয়াক্কা করে না। আমার যে একটা পার্সোনাল লাইফ আছে সেটা সে মানতে রাজি না। হয়তো আমিই সেই বেড়া টা উঠিয়ে দিয়েছিলাম।

পরিচয় হয়েছিল আমার বান্ধবী সামীনার বাসায়। আমরা ছিলাম একই ডিপার্টমেন্টে একই ক্লাসে।

 বন্ধু বান্ধবীর আমার অভাব নেই। অথচ আমি আজও চিরকুমার রয়ে গেলাম। লেখা পড়া আর অনেক ডিগ্রী গলার মধ্যে ঝুলাতে যেয়ে দেখলাম সময় পেড়িয়ে গেছে। না, সে কথা বললে ভুল হবে, দেখা হয়েছিল একজনের সাথে, অপর্ণা।

সে কথা থাক, এখন বলব সামন্তীর কথা।

কি আর করা। ফোন করতেই, সে বলল আমি জানি তুমি ঘুমাও নি। শোন, এক মাস পরে সামির গ্রাজুএশন। তোমাকেই সব ব্যাবস্থা করতে হবে।

-এই কথা বলার জন্য তুই আমাকে এত রাতে কল করেছিস ?  একটু রাগান্বিত স্বরে বললাম।

-হ্যা, কাল সকালে হয়তো মনে থাকবে না। তাই। তুমি রাগ করেছো? তুমি ছাড়া আর কে করে দেবে, বলও।

ও জানে আমি ওর উপর রাগ করলেও ওটা ক্ষণস্থায়ী।

-ঠিক আছে, কাল সন্ধ্যায় আসিস আমার বাসায়। কি কি করতে হবে সে বিষয় নিয়ে আলোচনা করা যাবে। এখন আমি একটু ঘুমানোর চেষ্টা করি। বলে আমি পাশ ফিরে শুলাম।

ওর সাথে পরিচয় হওয়া টাও একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা। সামীনার বাসায় দাওয়াতে এসেছিল কয়েকজন বন্ধু বান্ধবী। সামীনার হাতে ফুলের তোরা টা দিতেই চোখে চোখ পড়লো বসে থাকা বাচ্চা মেয়েটার দিকে। ওকে এড়িয়ে অন্যদের সাথে হাত মেলাতে যাবো তখনি সে বলে উঠলো, আমাকে আপনার চোখে পড়লো না?

ফিরে তাকালাম। মনে হোল বাচাল।

-না, তোমার সাথে পরিচয় নেই কিনা, তাই—

কথা শেষ না হতেই বলল, আমার নাম সামন্তী। আর ঐ যে ছেলে টা দেখছেন ও আমার ছেলে।

বুঝলাম ও আমাকে বুঝিয়ে দিল ও বাচ্চা মেয়ে নয়।

-ও তাই। তুমি কিন্তু লুকিয়ে রেখেছ তোমার বয়সটা তোমার আচলের ভিতর। বলে ভাবলাম, প্রথম পরিচয়ে এই কথা বলাটা ঠিক হোল কিনা।

সামীনা এসে দাড়াল, বলল, তোদের পরিচয় হয়েছে? ও সতীর ছোট বোন।

-আমিই পরিচয় করে নিলাম, সামীনা আপা। উনি তো আমাকে পেড়িয়ে চলে যাচ্ছিল ছোট মেয়ে ভেবে।

-তুই পারিসও বটে। বলে সামীনা চলে গেলো অন্য ঘরে। 

এ ঘরের সবাই আমার চেনা। ওর বোনের সাথেও আমার পরিচয় আছে, তবে ঘনিষ্ঠতা নেই।

ওর পাশেই বসলাম আমি।

-এসো, তোমার সাথে আলাপ-পরিচয় করি। বলে হাত টা বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, আমার নাম তৌফিক। 

আলাপে আলাপে জানলাম সে থাকে আমার থেকে পনেরো মাইল দুরে। স্বামী মারা গেছে বছর দুয়েক হোল।

ছেলের বয়স আট। বয়স তার ত্রিশ ছুঁই ছুঁই। থাকে একা। বোন থাকে বেশ দুরে। ঘণ্টা খানেকের পথ।

বললাম, পরিচয় হোল। এই আমার ফোন নাম্বার। আমি তোমার কাছাকাছিই থাকি। দরকার পড়লে কল দিতে ভুলো না।

কল একদিন এসেছিল, অনেক রাতে। ফোন টা ধরতেই কান্না কান্না স্বরে বলল, তৌফিক দা একটু আসবে আমার বাসায়, মুন্না যেন কেমন করছে।

ঠিকানা নিয়ে ওর বাসায় পৌছালাম, রাত তখন দুটো। মুন্না কে দেখে মনে হোল এখনি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া দরকার। নিয়ে এলাম কাছাকাছি একটা হাসপাতালে। কিছুক্ষণ বসে থাকার পর ওরা নিয়ে গেলো ভিতরে।

ওকে বললাম, কেঁদো না। ভিতরে যখন নিয়ে গেছে, সব ঠিক হয়ে যাবে।

ভোর সাতটায় মুন্না কে ছেড়ে দিল। ডাক্তার বলে দিল, ওর হাঁপানি রোগ আছে। ওটাই অ্যাটাক করেছিল। চিন্তার কোন কারন নেই। 

মুন্নার যে হাঁপানি রোগ আছে সেটাই সে জানতো না।

সেই ঘটনার পরে অনেক অনেক বার ও এসেছে আমার বাসায়। আমরা আপনি থেকে তুমি, তুমি থেকে তুই এ চলে গেছি।

আজ ও জানে ওর একটা বড় ভাই আছে কিছু দুরে। বিপদে আপদে সেই সম্বল। অধিকার টাও তার অনেক বেশি।

অনুষ্ঠান টা সম্পন্ন হয়েছিল খুব সুন্দর ভাবে। ওর বাসার ব্যাক ইয়ার্ডে।

স্পীচ দিতে যেয়ে কেঁদেছিল সে। কাঁদা টাই স্বাভাবিক।

সবাই যখন চলে গেলো, রইলাম শুধু সে আর আমি।

ও এসে বসলো আমার পাশে। বলল, তুমি এক হাতেই তো সব করলে।

বললাম, না, তুই তো পাশে ছিলি।

ও ওর মাথা টা আমার কাঁধে এলিয়ে দিলো। 

ওর মাথায় হাত দিয়ে বললাম, অনেকদিন ধরে বলছি, তোর বয়স আর কতই বা হোল এবার কারোর সাথে ঘর বাধার কথা চিন্তা কর।

ও বলল, জানো তৌফিক দা, তোমার জেনারেশন আর আমার জেনারেশনের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য।

তোমরা ভালবাসতে মন প্রান দিয়ে, আর এখনের ভালবাসা উড়ো উড়ো।

তুমি মনে করছ আমি চেষ্টা করি নি। অন লাইনে কয়েকজনের সাথে কথাও হয়েছে। দেখাও করেছি। কিন্তু কেউ কমিটমেন্ট করতে রাজে নয়। একজন তো বলেছিল, বিয়ে কেন,  চলো, আমরা বন্ধু হয়ে ঘুরে বেড়াই। সেটাই ভালো নয় কি? বোঝো?

একজন তো বেশ কয়েক দিন ঘোরার পরে  আর আমার টেক্সটের উত্তরই দিলো না। He ghosted me.

বুঝলাম, কেটে পড়েছে।

এসব ছেলেদের প্রবলেম টা কি বলও তো?

আমি বললাম, তা আমি কি করে বলব। আমি তো  তোদের যুগের মানুষ নই।

তারপর হাসতে হাসতে বলল, তুমিও শাদি ডট কমে তোমার নাম টা এন্ট্রি করো। নয়ত অন লাইনে ডেটিং কর। দেখবে পাকা চুলের কাউকে পেয়ে যাবে। আর কতকাল একলা থাকবে?

ও সব নিয়ে তোর চিন্তা করতে হবে না। বলে ওর মাথায় একটা চাট্টি মারলাম।

অতি কম বয়সে বিয়ে হয়েছিল তার।

কলেজে উঠেছে মাত্র। কোন এক বিয়ের অনুষ্ঠানে ওকে দেখেছিল ডাক্তার আসিফ আহমেদ। সবাই উনাকে চাচা বলে ডাকে। এসেছিল অনেক আগে এই দেশে। ফিরে আর যাওয়া হয়নি। এখানকার ডাক্তারির লাইসেন্স টা নিয়ে একটা হাসপাতালে চাকরি শুরু করেছিল। ধাপে ধাপে অঙ্কলজী ডিপার্টমেন্টের হেড হয়েছিল। দেখা হয়েছিল এক জার্মান মহিলার সাথে ঐ হাসপাতালে। তাকে নিয়েই ঘর বেধেছিল।

সামন্তী কে দেখে প্রস্তাব দিয়েছিল ওর মা র কাছে।

-আপনার মেয়ে টাকে কি আমি আমার পুত্রবধূ করে নিতে পারি?  বলে হাসতে হাসতে বলেছিল, এলাম বিয়ে খেতে আর এখানেই কিনা নতুন সম্বন্ধ করতে চলেছি।

 সামন্তীর মা বলেছিল,আপনার প্রস্তাব টা আলাপ করে দেখব অন্যদের সাথে।

সামন্তীই ছোট, অন্য পাঁচ মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। সামন্তীর বাবা মারা গেছে আজ প্রায় ছয় বছর হোল। মেয়ে আর জামাইদের উপর সে নির্ভরশীল।

তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ছোট টাকে পাড় করে দিতে পাড়লে উনিও শান্তি পান।

বড় জামাই রাজি ছিল না। তবে বলেছিল, আপনারা যা ভালো মনে করেন তাই করেন।

ধুমধাম করে একদিন বিয়ে হয়ে গেলো সামন্তীর আবিদের সাথে। কোন কিছু বুঝতে না বুঝতেই পেটে এলো  সামি। ওর জন্মের পাঁচ বছরের মাথায় আবিদ মারা গেলো গাড়ী দুর্ঘটনায়।

বলতে গেলে সামি কে ওর দাদা আসিফ আহমেদই কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে যতদিন বেচে ছিলেন। শাশুড়ি চলে গিয়েছিল তারও আগে।

ও একটা কপাল পোড়া মেয়ে।

আজ দশটা বছর ও জড়িয়ে আছে আমার জীবনে। সেই যে প্রথম দেখা হয়েছিল সেই থেকে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রইল আমার সাথে। কাজের শেষে প্রতিদিন আসে আমার বাসায়। কোনদিন বা রাতে খায় আমার সাথে, কোনদিন বা না খেয়ে চলে যায় সানির সাথে খাবে বলে।

সানির কথা ভাবতে ভাবতে আমি চলে যাই অনেক পিছনে। আমার ছোট বেলায়।

সবেদার মার চেহারাটা ভেসে ওঠে। থাকতো একটা কুঁড়ে ঘরে। মাঝে মাঝে আসতো মা র কাছে। সাথে আসতো সবেদা। আমরা দুজনে এক্কা দক্কা খেলতাম। আস্তে আস্তে সময় চলে গেলো পিছনে। ওর বিয়ে হয়ে গেলো। আমি তখন স্কুলের শেষ ক্লাসে। মা মানা করেছিল, বলেছিল এই অল্প বয়সে বিয়ে দিসনে। সবেদার মা বলেছিল, কি করব আপা, ওর বাবা নেই, আমারও বয়স হচ্ছে, হাজার হলেও মেয়ে তো।

বছর পাঁচেক পরে সাদা শাড়ী পরে ছোট্ট একটা মেয়েকে হাতে ধরে ফিরে এসেছিল ওর মার ভিটা তে। ওর মা তখন চলে গেছে। আমার মা র কাছে বাচ্চা টাকে রেখে যেতো অন্যের বাসায় কাজ করতে। কারো হাত সে আর ধরে নি। বাচ্চা টাকে মানুষ করবে এই ব্রতই সে নিয়েছিল। সে আজ অনেক আগের কথা।

জানি না আজ সে কোথায়। মনে হয় কোথায় যেন মিল আছে সামন্তীর সাথে।

আমি ভাবি, সানি চলে যাবে কলেজে। হয়তো দুরে। একলা হয়ে যাবে ও। শ্বশুরমশায় চলে গেছে। একলা ঘরে থাকবে একা।

বলেছিলাম চলে আয় আমার বাসায়। আমরা ভাই বোন মিলে কাটিয়ে দেবো বাদ বাকি জীবন টা। যতদিন না তুই খুজে পাশ কাউকে।

ও বলেছিল, তারপর ঐ যে তোমার আড়ালে আবডালে কথা বলার মানুষ গুলো, তাদের মুখ বন্ধ করবে কি ভাবে?

তুমি না হয় ঐ পথে পা বাড়াবে না কিন্তু আমাকে তো আজ হোক কাল হোক কাউকে পেতে হবে। সেকি আসবে? না ভুরু কুচকাবে?

বলেছিলাম, যার মনটা সন্দেহে ভরা তাকে তোর জীবনে জড়াবি কেনও?

তোমার মত সবাই নয় মিস্টার পণ্ডিত। বলে চা বানাতে চলে গিয়েছিল।

এক সন্ধ্যায় আমি বসেছিলাম আমার বাসার উঠানে। ছোট্ট এক চিতলে উঠান। দুটো ইজি চেয়ার পাতা। প্রতি সন্ধ্যায় আমি এখানে বসি। আজও তার  ব্যতিক্রম নেই। আকাশে আজ চাঁদ উঠেনি। শুধু ঝলমলে তারার সারি।

পিছনের দরজা খুলে এলো সে আমার উঠানে।

বললাম, এই ভর সন্ধ্যায়, কি মনে করে?

কেন, তোমার এখানে আসতে কল করে আসতে হবে নাকি?

-না তা নয়। বোস।

-এই সন্ধ্যার অন্ধকারে কি করছ?

-তাঁরা গুনছি।

-একটা কথা বলবে তৌফিক দা। যদিও কোনদিন আমি তোমাকে আমি জিজ্ঞাসা করিনি, আজ আর না জিজ্ঞাসা করে পারছিনা। বিয়ে শাদি করলে না কেন?

-মনের মত কাউকে পেলাম না বলে।

-এবার কাউকে খুজে নাও। আমি তো সারা জীবন তোমার কাছে থাকবো না। একদিন না একদিন তো আমি কাউকে খুজে পাবো। সেদিন হয়ত তোমার কাছ থেকে অনেক দুরে চলে যাবো। তুমি থাকবে একলা। এটা আমি সহ্য করতে পারবো না।

-পাগলি, চোখ টা মোছ। আমি একা কে বলল তোকে? ঐ যে দেখছিস আকাশের কোণে জ্বলজ্বল করছে তাঁরা টা। ওটা আছে আমার সাথে।

-মানে?

-ঐ তো অপর্ণা।

You may also like

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *