হাল্কা পাতলা ছেলে মহিম। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। যে কিনা মুখ গুজে পড়ে থাকতো বইয়ের পাতায়। ক্লাসে এসে বসতো সামনের সারির পরের সারিতে। সেই মহিম একদিন প্রেম করে বসবে তাহমিনার সাথে কেউ কি তা ভেবেছিল।
তাহমিনার সাথে প্রেম করতে চেয়েছিল সহিদ, নজিব, মিন্টু। তবে ওদের মধ্যে একটা কন্ডিশন ছিল। যে তাহমিনা কে পাবে সে অন্যদের কে সাতদিন ধরে সকালের নাস্তা খাওয়াবে। তথাস্তু বলে ওরা একটা কাগজে সই করেছিল। কাগজ টা আমাকে দিয়ে বলেছিল, এই তুই একটু আলাপ করিয়ে দেনা ওকে আমাদের সাথে।
আমার সাথে তাহমিনার কথা হয়। সে হেসে কথা বলে আমার সাথে, আমিও বলি। যেহেতু আমার মধ্যে ওর প্রতি কোন দুর্বলতা নেই কাজেই সহজ ভাবেই আমরা কথা বলি।
ওদের কে আমি বলেছিলাম, প্রেম তো অংক কষে প্লাস মাইনাস করে হয় না। সাহস করে এগিয়ে যা। বুক দুড়দুড় যদি করে তবে আর ও পথে পা বাড়াস না।
ওদের ভাগ্যে শিকে ছিড়ল না। শিকে ছিড়ল মহিমের ভাগ্যে। মহিমের জিত হোল।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে কেউ বা উচ্চশিক্ষার্থে কেউ বা চাকরির সন্ধানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। আস্তে আস্তে যোগাযোগে ভাটা পড়ল। হারিয়ে গেলো সহিদ, নজিব, মিন্টু।
তারপর বহু বছর পেড়িয়ে গেছে। আমি চলে এলাম অনেক দুরে। বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িয়ে পড়ে সময় টা কেটে যাচ্ছিল। এমনি একদিন নাট্যমেলায় দেখা মহিমের সাথে। চিনতে অসুবিধা হয়নি। সেও আমাকে চিনতে পেরেছিল। হাল্কা পাতলা সেই মহিম আর হাল্কা পাতলা নেই। মোটা ফ্রেমের চশমা হারিয়ে গেছে ডিজাইনার চশমার মাঝে। পাশে যে দাড়িয়ে ছিল তাকে তাহমিনার মুখমণ্ডলের সাথে মিলাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু মিললও না।
-কিরে চিনতে পারছিস না? বলে হাত টা এগিয়ে দিলো।
-পেরেছি, তবে—
কথা টা আমাকে সে শেষ করতে না দিয়ে বলল, পরিচয় করিয়ে দেই। অনামিকা। আমরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিন্ন ডিপার্টমেন্টের শিক্ষক।
কুশল আদান প্রদানের পর আমরা একে অপরের ফোন নম্বর নিয়ে নিলাম। সেই মুহূর্তে আমার ডাক পড়লো স্টেজ থেকে।
বললাম, এবার যেতে হবে। তুই চলে যাসনে।
-তুই কি নাটক করিস নাকি? একটু আশ্চর্য হোল সে।
বললাম, এই আর কি, সময় কাটান। ফিরে এসে যেন দেখা পাই তোর। বলে চলে গেলাম।
সব কিছু শেষ হতে একটু সময় নিলো। ফিরে এসে দেখলাম সে সেখানে নেই। খুজলাম হলের চারিদিকে।
কোথাও পেলাম না তাকে। একটা প্রশ্ন মনের মাঝে ঘুরে বাড়াচ্ছিল। যে প্রশ্ন টা করতে পারিনি অনামিকার সামনে।
ও বলেছে ওরা কলিগ। এই পর্যন্ত।
তাহলে—
আমার অংক মিললও না। দুয়ে দুয়ে চার হোল না।
কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ায় আর ফোন করা হয়ে উঠেনি।
ওর কাছ থেকেই কল এলো।
সেদিন ছিল শুক্রবার। কাজের শেষে দুই চারজন মিলে এসে বসেছিলাম রেস্তরাঁয়। এখানে আমরা প্রায় প্রতি শুক্রবারে আড্ডা দেই।
-হ্যালো বলতেই সে বলল, অত্যন্ত দুঃখিত। সেদিন শেষ পর্যন্ত না থাকা তে। অনামিকার একটা জরুরি কল এসেছিল। তাই চলে যেতে হয়েছিল। তা আমরা কি কোথাও একদিন বসতে পারি?
-অবশ্যই। তা কবে কোথায় তুই বল। বলে আমি কিচ্ছুক্ষণ চুপ করে রইলাম।
-রবিবার সন্ধ্যা ছয়টায় ডিটমাস আর থারটিসেভেন স্ট্রীটের কর্নারে একটা সিফুড রেস্টুরেন্ট আছে সেখানে।
বললাম, ঠিক আছে। দেখা হবে।
দেখা হয়েছিল সেদিন মহিমের সাথে। কোথা থেকে সে শুরু করবে ঠিক করতে পারছিল না।
আমিই জানতে চাইলাম তাহমিনার কথা।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তোর নিশ্চয় মনে আছে, আমাদের শেষ পরীক্ষার পরে আমরা সবাই মিলে বসেছিলাম তাজ রেস্টুরেন্টে।
বললাম, সে কথা কি ভোলা যায়।
সেদিন হৈ হুল্লার মাঝে তাহমিনা আমাকে বলেছিল, বাবা মা খুব চাপ দিচ্ছে বিয়ে করতে। বলেছিল, ওর মার ক্যান্সার ধরা পড়েছে। তাই কখন কি হয়, দেরি করতে চায় না।
ওকে বলেছিলাম, তাহলে আমি তোমার বাবা মা কে বলি, যদিও আমার এই মুহূর্তে কোন চাল চুলো নেই। কিন্তু ডিপার্টমেন্ট থেকে বলেছে রেজাল্ট বের হবার পরে আমাকে লেকচারার করে নেবে।
আমি জানতে চাইলাম কি হয়েছিল তারপর।
সে বলল, দেখা করলাম, ওর মা বলল, আগে লেকচারার হও তারপর দেখা যাবে।
তুই তো জানিস লেকচারার পদ টা আমি পাইনি।
বললাম, জানি তোকে দেওয়া হয়নি। কারন তুই প্রথম হতে পারিস নি। হয়েছিলি দ্বিতীয়।
-হ্যাঁ। কয়েকদিন পরে গিয়েছিলাম ওদের বাড়ীতে। ওর মার তখন অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে। নিশ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছে। ও এসে বলেছিল, তুমি এখন যাও। পরে কথা হবে।
তারপর অনেক দিন সে আর যোগাযোগ করেনি। আমি ওর মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছিলাম।
বেশ কিছুদিন পরে গেলাম ওদের বাসায়। থমথমে ভাব। তাহমিনা এলো। দেখে মনে হোল অনেকদিন ঘুমায়নি। শুধু বলল, মা আর নেই।
বলতে চাইলাম, আমাকে একটু জানালে পারতে? না, আমার বিবেকে বাধল। এই মুহূর্তে কোন প্রশ্ন নয় শুধু শোনা।
সে বলল, আমরা যা ভেবেছিলাম তা এখন হবার নয়। বাবার দেখাশুনার ভার আমার। অন্য কোনকিছু আমি এই মুহূর্তে চিন্তা করতে পারছি না।
ঘণ্টা খানেক বসেছিলাম ওদের বৈঠকখানায়। ওর বাবার সাথে দেখা হয়নি। ও এক সময় এসে বলল, খেয়ে যেও।
বললাম, না, আজ আসি। এই বলে বেড়িয়ে এসেছিলাম।
তারপর বেশ কয়েক মাস চলে গেছে পিছনে। মাঝে মধ্যে গিয়েছি ওদের বাসায়। কোন সময় ওর দেখা পেয়েছি কোন সময় পাইনি।
এর মাঝে একটা স্কলারশিপ পেয়ে গেলাম আমেরিকা যাওয়ার। দেখা করলাম ওর সাথে। ও বলল, যাও, ফিরে এলে বাধবো সংসার।
আমি কালামারী খেতে খেতে শুনছিলাম ওর কথা। ও থামতেই জিজ্ঞাসা করলাম, তারপর?
-সেই শেষ দেখা।
-মানে? আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম।
তুই তো জানিস সেই সত্তর দশকে আমেরিকা আর বাংলাদেশের সাথে ফোনে যোগাযোগের ব্যবস্থা আজকের মতো ছিল না। তাছাড়া ওদের বাসায় ফোন ছিল না। শুধু চিঠির উপর নির্ভরশীল।
সেই চিঠিও একদিন বন্ধ হয়ে গেলো। আমি উতলা হয়ে উঠলাম। দেশে যেতে চাইলেই যাওয়া সহজ নয়। তাছাড়া আমার থিসিস জমা দিতে হবে। দেড়ি হয়ে গেলো যেতে। যখন গেলাম ওর খোঁজ আর পেলাম না।
আবার ও আমি অবাক হলাম। খোঁজ পেলিনা মানে?
ওদের বাসায় যেয়ে কড়া নাড়তেই যে এসে দরজা খুলে দিলো তাকে আমি চিনিনা। জিজ্ঞাসা করলাম, এই বাসায় যারা থাকতো তারা কোথায়।
সে বলল, সে জানে না।
ভিতর থেকে এক ভদ্রলোক বেড়িয়ে এলেন। বলল, এই বাড়ীর লোকেরা চলে গেছে। আমরা ভাড়া নিয়েছি এই বাড়ী।
কোথায় গিয়েছে? জিজ্ঞাসা করতেই বলেছিল
জানিনা, বলে গেছে ভাড়াটা আমার এক আত্মীয় মাসে মাসে এসে নিয়ে যাবে।
এরপর আর তাকে খুজে পাইনি। দেশেও আর ফিরে যাইনি। বলে সে আমার চোখ থেকে চোখ সরিয়ে তাকিয়ে রইল প্লেটের দিকে।
বুঝলাম, নিজেকে কান্না থেকে সংবরণ করার চেষ্টা করছে।
আমি সেই মুহূর্তে আবহাওয়া টাকে হাল্কা করার চেষ্টায় বললাম, তা সেই অনামিকা টা কে?
মহিম তাকাল বলল, নিতান্তই বান্ধবী। এবার জিজ্ঞাসা করবি বিয়ে করেছি কিনা। না করিনি।
দুজন দুজন কে বিদায় দিয়ে যখন রাস্তায় নামলাম তখন বৃষ্টি পড়ছে। ও চলে গেলো ওর গাড়ীর কাছে।
আমি বসলাম আমার গাড়ীতে। নিজের মনে মনেই বলতে থাকলাম কেন দুটো জীবন এক না হয়ে দুদিকে চলে গেলো। তাহমিনা, সেই বা কোথায়?
এখানেই নাটকের যবনিকা হওয়া উচিৎ ছিল । কিন্তু হোল না। আমরা ভাবি এক আর উপরওয়ালা ভাবেন অন্য ভাবে।
মহিমের সাথে আমার যোগাযোগ রয়ে গেলো। আমরা প্রায় মিলিত হই। কখন বা ব্রেকফাস্টে কখনও বা লাঞ্চে।
ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে কখন যে ১৯৮০ থেকে ২০২৩ এ চলে এসেছে বুঝতে পারিনি। চুল সাদা হয়েছে। মাজাতে ব্যাথা। রাতে গাড়ী চালাতে গেলে রাস্তার দাগ গুলো দেখতে পাইনা স্পষ্ট ভাবে।
মেয়েকে ব্যাথার কথা বললে সে হাসতে হাসতে বলে, আব্বু তুমি মাঝে মাঝে ভুলে যাও তোমার বয়স হয়েছে।
মহিমের অবস্থা আমার চেয়েও খারাপ। পড়ে যেয়ে মাজায় চোট পেয়েছিল ভীষণ। থেরাপি তে কাজ হয়নি। ডাক্তার বলেছে অপারেশন করতে হবে। বাসায় দেখার লোক নেই। অগত্যা তাকে যেতে হয়েছে নার্সিং হোমে। আমি সপ্তাহে একদিন যাই। বসে গল্প করি।
সেদিনও নিয়ম মাফিক বিকেলের দিকে উপস্থিত হলাম। ওকে দেখলাম না ওর রুমে। নার্স কে জিজ্ঞাসা করতেই বলল সে লনে বসে আছে।
গেলাম, একজন মহিলার সাথে বসে গল্প করছে। ও আমাকে দেখল। চোখে হাসির ছোঁয়া। আমি এগিয়ে এলাম।
দাঁড়ালাম ওদের পাশে। তাকালাম মহিলার দিকে। চেয়ে রইলাম অবাক দৃষ্টি তে।
তাহমিনা? মুখ দিয়ে অস্পষ্ট ভাবে বেড়িয়ে এলো।
-তাহলে চিনতে পেরেছ? বলে হাসতে লাগলো।
আমি কি বলব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
-বস। বলছি সব। বলে হাসতে থাকলো মহিম।
অনেকদিন ওকে এই ভাবে প্রান খুলে হাসতে দেখিনি।
সে বলতে আরম্ভ করলো, গত পরশুদিন রাতে গিয়েছি ডাইনিং রুমে। খেতে খেতে তাকালাম দুটো টেবিল পরে কর্নারের টেবিল টার দিকে। দেখলাম মহিলা তাকিয়ে আছে আমার দিকে। চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। চশমাটা খুলে মুছে নিলাম। না, ভুল দেখিনি। তাহমিনা। সেও তাকিয়ে আছে অবিশ্বাসের মত।
আমি লাঠি টা হাতে নিলাম। আস্তে আস্তে এলাম ওর টেবিলে।
জিজ্ঞাসা করলাম তুমি এখানে কবে এলে।
সে বলল, গত পরশু।
আমি জানতে চাইলাম কেউ আছে সাথে।
সে বলল, না। তোমার?
আমি বললাম, না কেউ নেই।
জিজ্ঞাসা করিনি এতদিন কোথায় ছিলে। সে সব অতীত। অতীত নিয়ে ঘাটা ঘাটি করতে চাই না।
ঠিক করেছিস। আমি বললাম।
তাহমিনার চোখের হাসিটা আমি ভুলতে পারছিলাম না। সারা মুখ টা ঘিরে একটা আলোর জ্যোতি ফুটে উঠছে।
আমি বললাম, আজ থেকে আমার আর আসার দরকার নেই।
-বাজে কথা থাক। কাল একটু সকাল সকাল আসিস কথা আছে।
সন্ধ্যা হওয়ার আগেই বেড়িয়ে পড়লাম। ওদের দুজনের মুখটা আমার চোখের সামনে ভাসতে থাকলো।
যুগ যুগ আগে ওরা যা চেয়েছিল আজ তা সম্পন্ন হতে চলেছে। বিনোদনের হল টা সাজানো হয়েছে বিভিন্ন ফুল দিয়ে। দুটো চেয়ার পাশাপাশি। মহিমের এক হাতে হাটার লাঠি অন্য হাত দিয়ে শক্ত করে ধরেছে তাহমিনার হাত। পরনে লাল পাঞ্জাবি। তাহমিনা পড়েছে সাদার উপর ছোট ছোট লালের ফোঁটা আর লাল পাড়ের শাড়ী। অপূর্ব লাগছিল ওকে।
ওরা এসে বসলো চেয়ারে। মাথায় টুপি পরে মওলানা সাহেব এসে দাঁড়ালো পাশে।
আমি হলাম সাক্ষী।