অপরিচিতা

  সকাল নয়টা। সূর্যের আলো টা জানালা দিয়ে এসে অনন্তর চোখের উপর পড়ছিল। কতবার তৃপ্তি কে বলেছে  একটা কালো পর্দা দিয়ে ডেকে দিতে। আজও তার সময় হয়নি। বিছানা থেকে উঠতে যেয়ে বাম পা টা ব্যাথায়  টনটন করে উঠলো। কোন রকমে  পা টা টানতে টানতে রান্না ঘরে এসে দাঁড়ালো অনন্ত। তৃপ্তি বেড়িয়ে গেছে। প্রথমে যাবে জিমে। তারপর বান্ধবীদের সাথে আড্ডা দেবে। ফিরতে ফিরতে এগারটার উপর হয়ে যাবে।

অনন্তর নিজের নাস্তাটা নিজেই করে নিতে হবে। ব্যাথা টার তীব্রতার জন্য বেশিক্ষণ দাড়িয়ে থাকতে পারে না। কফির পটটা আনতে যেয়ে হাতের লাঠি টা পড়ে গেলো মেঝেতে। অনন্ত জানে নিচু হয়ে সে উঠাতে পারবে না। একবার চোখ বুলিয়ে নিলো চারিদিকে। কোথাও রীচার গ্রাবার টা দেখতে পেলোনা। পাশে থাকা স্টুল টা টেনে নিয়ে এলো। ওটাতে বসে ডান হাতটা নামিয়ে দিলো নিচে। প্রথম বার ছুঁতে পাড়লও না। আর একবার চেষ্টা করতেই তীব্র ব্যাথায় সারা মুখ নীল হয়ে এলো।

যাক উঠাতে পাড়লও সে। কিছুক্ষন বসে রইল।   ব্যাথা টা একটু কমে আসতেই উঠে দাঁড়ালো। কফি টা বসিয়ে দিয়ে এলো ফ্রিজের কাছে। পাউরুটি আর জেলি টা নিয়ে রাখল টেবিলে। তৃপ্তি বাসায় না থাকলে সকালের নাস্তা টা সে এই ভাবেই সেরে নেয়।

কফিটা তে চুমুক দিয়ে দেয়ালের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল ওর আর তৃপ্তির ছবি টা। বিয়ের আগে তোলা।

অনন্ত তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে থাকলো তৃপ্তির ঠিক ঠোটের নিচের তিল টাকে। ঐ তিল টাই ওকে আকর্ষণ করেছিল। আজ থেকে অনেক বছর আগে তোলা এই ছবি।

তৃপ্তির সাথে দেখা হয়েছিল এক রেস্টুরেন্টে।

 অনন্ত, স্বপন আর সন্ধ্যা কর্নারের একটা টেবিলে কফি নিয়ে বসেছিল।

হঠাৎ দেখতে পেলো তার পরিচিত একজন কে, সুপর্ণা। সাথে তিন বান্ধবী।

সুপর্ণার সাথে চোখাচোখি হতেই সুপর্ণা এগিয়ে এলো।

-কেমন আছো অনন্ত। তোমার তো ইদানীং পাত্তা পাওয়া যায় না। থাকো কোথায়? বলে সুপর্ণা অনন্তর উত্তরের অপেক্ষা না করে পরিচয় করিয়ে দিলো ওর বান্ধবীদের সাথে। তৃপ্তি, তাসনিম, মমতা।

-তোমাদের কোন আপত্তি না থাকলে বসো আমাদের সাথে। একসাথে আড্ডা দেই। সুপর্ণা কে  কথাটা বলে অনন্ত তাকাল তৃপ্তির দিকে।

সেইক্ষণে সে দেখতে পেলো ঐ তিল টা।

চোখ টা আটকিয়ে গেলো।

-কি, হ্যাঁ করে কি দেখছ। কপট হাসির ভান করে জিজ্ঞাসা করলো সুপর্ণা।

একটু লজ্জা পেলো অনন্ত। পরক্ষনে  নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে বলল, না, দেখছি তোমার সুন্দরী বান্ধবীদের।

-হু, তা কোনটাকে পছন্দ?

-আহ, তুমি সেই আগের মতই রয়ে গেছো। বসো, কি খাবে বলও।

-দেখি মেনুতে কি আছে। ঘাড় যখন তোমার ভাঙ্গব তখন ভালভাবেই ভাঙ্গি।

-কুছ পরোয়া নেই। বলে চেয়ার টা একটু পিছনে ঠেলে দিলো।  

ওরা বসলো একসাথে।

দুই একবার চোখাচোখি হোল তৃপ্তির সাথে।

আড্ডা টা বেশ ভালই জমেছিল

বের হয়ে যাওয়ার আগে অনন্ত সুপর্ণা কে একটু পাশে ডেকে নিয়ে যেয়ে বলল, এই ঐ যে মেয়েটা ঠোটের নিচে তিল, নাম টা যেন কি?

-তৃপ্তি

-লাইন আছে ওর না থাকলে লাইন টা আমার সাথে লাগিয়ে দাও

-হু, মনে ধরেছে তাহলে

-ধরেছে তো

– ঠিক আছে, কাল সন্ধ্যা সাত টায় এইখানেই আবার এসো সুপর্ণা অনন্তের হাতে একটা চিমটি দিয়ে হাসতে হাসতে বের হয়ে গেলো।

তৃপ্তি এসেছিল

 সুপর্ণা ওদের দুজনকে রেখে কোথায় যে চলে গেলো এলো দুই ঘণ্টা পড়ে

এই দুই ঘণ্টায় ওরা অনেক কথা বলল, দুজনের মধ্যের লজ্জার আবরণ টা কোথায় যেন মিলিয়ে গেলো

তারপর ওরা আবারও মিলল একসাথে হাত ধরাধরি করে হাঁটল ঠোঁটে ঠোঁট রাখল

তারপর একদিন ওরা হয়ে গেলো মিস্টার আর মিসেস

দরজা খোলার শব্দ হোল তৃপ্তি ঢুকল

অনন্ত ছবিটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে তাকালও দরজার দিকে।

-নাস্তা করেছো? গায়ের কাপড়টা খুলতে খুলতে জিজ্ঞাসা করল তৃপ্তি।

-করেছি তবে অনেক কষ্টে। বলে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো।

-সরি, আমাকে এখুনি দোকানে যেতে হবে। কতগুলো কাপড় ডেলিভারি দেবে। আমি না থাকলেই নয়। তুমি উবার ইটে দুপরের খাবার অর্ডার দিয়ে দাও। একটু বেশি করে দিও তাহলে রাতেও খেতে পারবে। আমার আসতে দেরি হতে পারে। আমি বাহিরে খেয়ে আসবো। এই বলে তৃপ্তি সাওয়ার নিতে চলে গেলো।  

অনন্ত আস্তে আস্তে এসে বসলো বাহিরের বারান্দায়। কুয়াশায় তখনো ঘাস ভেজা। দুটো শালিক কিচিরমিচির করছে ওর বারান্দার কোনায়। অনন্ত তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল  শালিক দুটো কে। আর ভাবছিল,

কোথায় গেলো সেইদিন গুলো। যখন তৃপ্তি বসে থাকতো  অনন্তের জন্য ভাতের থালা আগলে। কাজ থেকে আসতেই দরজা খুলে প্রথমে একটা চুমো দিয়ে বলতো, তাড়াতাড়ি গোসল করে এসো, আমার অনেক খিদে পেয়েছে।

অনন্ত ওকে কাছে টেনে নিয়ে বলতো, কতদিন বলেছি, তুমি খেয়ে নিও, তারপর আমি খেতে বসলে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করো।

-আহারে, এসব বুঝি শরৎচন্দ্রের বই তে পড়েছ।

-হ্যাঁ, কিন্তু আমার শরৎচন্দ্র হারিয়ে গেছে।

-না হারায় নি, মডার্ন হয়েছে। আমি এয়ারকন্ডিশন চালিয়ে দিয়েছি। বলে হেসে উঠত। আর ঠিক সেইক্ষণে অনন্ত আলতো করে চুমো দিতো ঐ তিল টার উপর।

সেইসব দিনগুলো  একদিন কর্পূরের মতো উবে গেলো।

তৃপ্তির অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল একটা বুটিকের দোকান দেবে। অনন্ত কে বলেছিল। অনন্ত না করেনি।

-কিন্তু টাকা কোথায় পাবো?

-শোন, ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। যদি চাও তবে হোম ইকিউটি নিয়ে আরম্ভ করো। বলেছিল অনন্ত।

-ভয় হয়। যদি ব্যবসাটা দাড় করাতে না পারি। তাহলে টাকা শোধ দেবো কি ভাবে। তৃপ্তি ভয়ে ভয়ে বলেছিল।

অনন্ত আশ্বাস দিয়েছিল। বলেছিল, চেষ্টা করতে দোষ কি?  তোমার উপর আমার অগাধ বিশ্বাস। তুমি পারবে।

পেরেছিল সে। আস্তে আস্তে ছোট্ট দোকান টাকে অনেক বড় করেছিল।

শুধু হারিয়ে গিয়েছিল সেই  বৌ টা।

দেরি করে ফিরতে আরম্ভ করলো তৃপ্তি। জিজ্ঞাসা করলে বলে দোকানে কাজ ছিল অনেক। অনন্ত বসে থাকে ওর জন্য এক সাথে ডিনার করবে বলে। তৃপ্তি খেয়ে আসে বাহিরের থেকে।

বললে বলে, তুমি এখন থেকে খেয়ে নিও। আমার জন্য বসে থেকো না।

এর মাঝে একদিন  এক অঘটন ঘটলো। গাড়ীর এক্সিডেন্টে অনন্ত বাম পায়ে প্রচণ্ড আঘাত পেলো। সেই সাথে মাজায়।  ডাক্তারেরা অনেক চেষ্টা করল পা টাকে আবার আগের অবস্থাতে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু পাড়লও না।

চাকরি থেকে আর্লি রিটায়ারমেন্ট নিয়ে বাসাতে বসে থাকতে হোল।

প্রথম দিকে তৃপ্তিই ওকে দেখাশোনা করতো। ক্রমেই কয়েকটা মাস পাড় হতেই অনন্ত বুঝতে পাড়লও তৃপ্তি আস্তে আস্তে দুরে সরে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক থাকে। ডাকলে সাড়া দেয়না।

এক রাতে বারান্দা বসে তৃপ্তি বলল, এবার একটা লোক রাখো, আমি আর পেরে উঠছি না। ঘরে বাহিরে আমার পক্ষে সামলানো দায় হয়ে উঠেছে।

কথাটা একটু ঝাঁঝালো স্বরে বলেছিল তৃপ্তি।  

কিছুক্ষন চুপ করেছিল অনন্ত।

কোথায়, সে তো নিজের কাজ যতটা পারে নিজেই করে। কাপড় জামা এখনো নিজেই পড়ে, তবে একটু কষ্ট হয়। টয়লেটে নিজেই যেতে পারে। শুধু যখন ব্যথাটা প্রচণ্ড আকার ধারন করে তখন বিছানা থেকে নামতে গেলে নামতে পারেনা।

অনন্ত তৃপ্তির দিকে তাকিয়ে বলেছিল, একটা লোক রাখতে তো অনেক টাকার দরকার।

তৃপ্তি কোন কথা না বলে উঠে ঘরের দিকে চলে গেলো।

বাড়ীতে অশান্তি দেখা দিলো।

তৃপ্তি একদিন বলল, সে আর রান্না করতে পারবে না। তার সময় নেই। খোঁজ নিতে বলল, কাউকে পাওয়া যায় কিনা যার কাছে অর্ডার দাওয়া যাবে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পাওয়া গেলো তসলিমা কে।

ইয়ং মেয়ে। ছোট একটা বাচ্চা আছে তার।

রান্না ভালো করে। অনন্ত বলেছিল, তোমাকে কিন্তু বাসায় দিয়ে যেতে হবে।

-কোন অসুবিধা নেই ভাইয়া।

মাঝে মাঝে খাবার দিতে এসে তসলিমা বসে।  গল্প করে অনন্তর সাথে। অনন্ত ওকে বিভিন্ন লেখকের বই পড়ে শোনায়।

বলেছিল, ওর বড় ভাই এর কথা। একদিন কাজ থেকে এসে বলল, মা শরীর টা ভালো লাগছে না। আজ আর খাবো না। একটু শুয়ে থাকি। সেই শোয়াই তার শেষ শোয়া। বলে অনেক কেঁদে ছিল।

আরও বলেছিল, তুমি ঠিক আমার বড় ভাই এর মতো। সে ও আমাকে বই পড়ে শোনা তো। সে আমার বিয়ে দেখে যেতে পাড়লও না। আমার সংসার দেখল না।

আচ্ছা ভাইয়া, ভাবী কে দেখি নাতো। অনেক ব্যস্ত বুঝি।

-অনেক।

-তোমার এই পা আর ভালো হবে না?

-না, অসুবিধা কি। এই লাঠি টা তো আছে। বলে হাল্কা করতে চায় পরিবেশ টাকে অনন্ত।

সেদিন তৃপ্তি একটু তাড়াতাড়িই বাসায় এলো। যেটা অনেক অনেক দিন ধরে হয়নি।

-আজ একসাথে আমরা ডিনার করবো। বলে ফ্রীজ টা খুলে দেখল তৃপ্তি।

এরকম প্রত্যাশিত ঘটনা ঘটেনি অনেকদিন। অনন্ত তৃপ্তির দিকে বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল। আনন্দে সে আত্মহারা।

আবার বুঝি ফিরে এলো সেই হারিয়ে যাওয়া দিন গুলো।

মনে মনে অনেক কিছু ভাবল অনন্ত। ঐ তিল টাতে আবার আজকে সে চুমো দেবে। খাওয়ার আগে না খাওয়ার পরে।

তৃপ্তি কাছে আসতেই অনন্ত উঠে দাড়িয়ে ওকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করতেই সে অনন্ত কে আস্তে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে  বলল, কি ঢং আরম্ভ করলে।

অনন্ত অপ্রত্যাশিত এই ধাক্কা টা সামলিয়ে নিয়ে বলল, এসো না ওই ঢং টাই আমরা আবার করি। আচ্ছা তোমার মনে পরে না আমাদের সেই প্রেমের কথা। তুমিই না হয় আমার লাঠি হয়ে দাড়াও আমার পাশে। চল আমরা বেড়িয়ে আসি কাছে কোন এক জায়গা থেকে।

তৃপ্তি তাকালও অনন্তের দিকে। কোন উত্তর না দিয়ে ভাত বাড়তে বাড়তে বলল, আমি দিন পাচেকের জন্য বাহিরে যাচ্ছি। নিজের চোখে দেখে কাপড়ের অর্ডার গুলো দিতে চাই। তোমার একা থাকতে কোন অসুবিধা হবে?

-অসুবিধা হলেই বা তুমি কি করবে বলও। তবে কোথায় যাচ্ছ? একটু রেগেই বলল অনন্ত।

-স্টেটসের বাহিরে। 

-কবে যাবে?

-আগামীকাল দুপুরে আমার ফ্লাইট। হঠাৎ করেই যেতে হচ্ছে।  দরকার পড়লে আমার হোয়াটস আপে কল দিও।

-কোন হোটেলে থাকবে?

-হিলটনে।

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপচাপ। শুধু চামচের টুংটাং শব্দ।

অনন্ত নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, আচ্ছা তৃপ্তি আমি কি সত্যিই তোমার কাছে একটা বোঝা হয়ে উঠেছি।

-দেখো এই ধরনের প্রসঙ্গ আমি শুনতে চাই না। বলে উঠে দাঁড়ালো তৃপ্তি।

-তৃপ্তি, শোন, আমি এখনও পুরপুরি অথর্ব হয়ে যাইনি। এখনো লাঠি ভর দিয়ে অনেক দুর যেতে পারবো। আমি শুধু  চাই তুমি আমার পাশে এসে দাড়াও। ঐ বুটিক শপ একদিন আমিই তোমাকে করার জন্য উৎসাহ দিয়েছিলাম। আজ সেই বুটিক শপই আমার কাল হয়ে দাঁড়ালো।

-ও। তোমার হিংসে হচ্ছে? বলে তৃপ্তি তাকালও অনন্তের দিকে।

– হিংসে কেনও হতে যাবে। বরং আমার গর্ব হচ্ছে। তুমি ছোট্ট একটা দোকান কে কত বড় করে তুলেছ। মনে নেই সেদিন আমি বলেছিলাম, তুমি পারবে।

তুমি পেরেছ। তুমি পেরেছ।  আমি হারিয়েছি।

-তোমার সাথে তর্ক করার ইচ্ছে আমার  নেই, আমি ঘুমতে গেলাম। বলে তৃপ্তি চলে গেলো তার রুমে।

অনন্ত আরও কিছুক্ষণ বসে রইল। তারপর আস্তে আস্তে উঠে টিভি টা চালিয়ে দিলো।

দুইদিন পার হয়ে গেছে। তৃপ্তি ফোন করে নি। অনন্ত অস্থির হয়ে লাঠি ভর দিয়ে একবার এঘর, ওঘর করে বেড়াতে লাগলো। কত বার কল করলো ওর হোয়াটস আপে। তৃপ্তি ফোন ধরলও না।

তৃতীয় দিন রাত দশটায় ফোন করল, বেশ কিছুক্ষণ বাজার পর ফোন টা ধরল।

হ্যাঁলো বলল, এ স্বর কোন মেয়ের নয় ছেলের।

অনন্ত কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, তৃপ্তি কোথায়।

লাইন টা কেটে দিল, যে ধরে ছিল ফোনটা।  

অনন্ত চোখ বন্ধ করে বসে রইল।

You may also like

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *