বেণী পাগলী

বেণী পাগলী, বেণী পাগলী চলে গেছে, আর আসবে না কোনদিন। কিন্তু সে তো আমার মন থেকে চলে যেতে পারিনি। এখনো আমার চোখে ভাসে বেণী পাগলীর চেহারা। পরনে ছেড়া শাড়ি গায়ের সাথে পেঁচানো। হাতে একটা ঝোলা। এলোমেলো চুল, কত দিন ওটার উপর চিরুনির আঁচড় পরেনি কে জানে। চোখের চাহুনীতে মনে হয় কি জেনো খুঁজছে। পাচ্ছেনা।

যশোরের বাগমারা পাড়ায় আমাদের বাসা। আমার বয়স পাঁচ। গোপাল, শিবু, দীলিপ, খোকন আমরা সবায় এক বয়সী। মারবেল খেলার সঙ্গী। দীলিপ চীৎকার করে উঠলো, “ বেণী পাগলী, বেণী পাগলী”। দোর, ছুট। কেন বেণী পাগলী কে দেখে ভয় পেতাম তা আজও জানিনা। দুর থেকে ডাকতো আমাদের কে। দেখাতো হাতে আম গাছ থেকে পারা লাঠি টা। আমরা ভেংচি কাটতাম দুর থেকে।

মাঝে মাঝে গাছের ছায়ায় বসে মাথার উকুন মারতো। ঝোলাটা পাশে। একটু কাছে যেয়ে বলতাম,” এই বেণী, তোর ওই ঝোলাতে কি রে?” বলতো,” সাপ, গোখরো সাপ, আয়, কাছে আয়”। ভয়ে চোখ বড় বড় হয়ে যেতো আমাদের। একটা মারবেল ছুড়ে মারতাম ওই ঝোলাটার দিকে, সাপ টা ফোঁস করে ওঠে কিনা দেখার জন্য। বেণী পাগলী লাঠি নিয়ে তাড়া করতো। দে ছুট।

একদিন খেলা শেষে বাসাতে এসে দেখি বেণী মার সাথে উঠোনে বসে। ওমা, দেখে আমার চক্ষু ছানা বড়া। ভয়ে আমি জড়সড়। বেণী আমার দিকে চেয়ে ফিক করে ফোকলা দাঁত বেড় করে হাসলো। পাশের ঝোলা তে হাত দিতেই আমি চীৎকার করে উঠলাম। মা- গোখরো সাপ। কোথায় সাপ, মা ধমক দিলো আমাকে। “ ওই তো, ওই ঝোলার মধ্যে। বেণী পাগলী আবারো ফিক করে হাসল। মা ঝোলা টা টেনে এনে ভেতর থেকে একটা বড় কোঁটা বেড় করলো। তার মধ্যে চাল। মা আরেক বাটী চাল ওর মধ্যে দিয়ে দিলো। বেণী উঠে পড়ল। আমার দিকে তাকাল। এ দৃষ্টি টা সেই আগের দৃষ্টি নয়, মমতায় ভরা। ও চলে গেলো। আমি মাকে বললাম’ মা আমি ওকে ভয় পাই। কেন? জানিনা। মা আর কথা বাড়াল না।

বেণী থাকতো রেল স্টেশনের কাছে। ওদিকে গেলেই ওকে দেখতাম ছেড়া কাপড় পরে বসে আছে গাছের নিচে। কাঁঠি দিয়ে পিঁপড়ে গুলোকে বের করছে আর মারছে। আমি হাঁটতাম রাস্তার উলটো দিক দিয়ে। সে আমার দিকে তাকাত আর ফিক করে হাসতো।

আরও অনেক বার দেখেছি তাকে মার সাথে বসে গল্প করতে। কিন্তু ভয় আমার কাটেনি। সময় পেড়িয়ে গেলো। বাবা বদলি হয়ে আমাদের কে নিয়ে চলে গেলেন অন্য শহরে।

তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। একদিন যশোরের উপর দিয়ে খুলনা যাবো বোনের বাসায়। মনে পড়ল ছোটো বেলার কথা। nostalgia আমাকে পেয়ে বসলো। নেমে পড়লাম বাস থেকে। একটা রিকশা নিয়ে গেলাম সেই বাগমারা পাড়ায়। চিনতে অসুবিধা হোল। আমরা যে বাসাতে থাকতাম সেখানে উঠেছে বিরাট প্রাসাদ। শিবু দের বাসার সামনের আমগাছ টা নেই। মারবেল খেলার জাগাটা পাকা করে মুদির দোকান বসেছে। একটু এগিয়ে পুকুর, যেখানে সাঁতার শিখেছিলাম, সেখানে উঠেছে বিশাল অট্টালিকা। আমার ছোট বেলার স্রীতি হারিয়ে গেলো। মনে পড়ল বেণী পাগলীর কথা। রিকশা ওলা কে বললাম,” চলো রেল স্টেশনের দিকে”। পোঁছালাম। যে গাছটার নীচে বেণী বসে থাকতো তার কোন চিহ্ন পেলাম না। নেমে পড়লাম। ভাড়া মিটিয়ে এগিয়ে গেলাম সামনের দোকানের দিকে। না এরা জানবেনা, এরা অতি অল্পবয়সী।

দুরে একটা চা স্টলের সামনে দুজন বয়স্ক লোক চা পান করছে। আমার পরিচয় দিয়ে বললাম অনেকদিন আগে এই শহরে আমি বাস করতাম। বেণী নামে এক পাগলী এখানে ছিল। চেনেন কি? বলল, “ না, তবে ওই যে দেখছেন ছোট দোকান টা ওটার মালিক এখানকার আদিবাসী। উনি আপনাকে হয়ত সন্ধান দিতে পারে।”

দোকানে পা দিতেই ভদ্রলোক তাকালেন। বেশ বয়স্ক। নাম হরিহর ঘোষাল। জিজ্ঞাসা করলাম বেণীর কথা। হরিহর বাবু কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। বললেন,” একটু দেরী হয়ে গেলো। আজ বছর সাতেক হোল মারা গেছে। যে গাছটার কথা বলছেন ওর নিচেই সে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছিল। দাফন দেওয়ার কেউ ছিলোনা। আমরা সবাই মিলে ব্যবস্তা করে ছিলাম। ওর জীবন ইতিহাস আপনি কি জানেন।” বললাম,” না, আমি তখন অনেক ছোটো, শুধু ভয়ই পেতাম ওকে দেখে।” তবে শুনুন,” ও ছিল এক গেরস্ত ঘরের মেয়ে। এখান থেকে দুই মাইল পুবে গেলে ওদের গ্রাম। বাবার ছিল চালের ব্যবসা। একই মেয়ে। নাম ছিল বনানী। বাবার চোখের মনি। আদর দিয়ে মেয়ে কে মানুষ করেছিল। প্রায় বলত, “ জানো হরি, মেয়ে আমার একদিন বড় ডাক্তার হবে। দেখে নিও।”একদিন দুজনে মিলে বনানী কে নিয়ে গিয়ে ছিলাম মেলায়। ওর চুলের ফিতে লাগবে। লাল রং এর। ও তখন তিন বছর মাত্র। আমরা কথায় বাস্ত। হঠাৎ করে তাকিয়ে দেখি বনানী নেই পাশে। আমাদের বুক টা ধড়াস করে উঠলো। চীৎকার করে নাম ধরে ডাকতে থাকলাম। ওর বাবার চোখে জল। কি হবে হরি। বললাম ধরজো হারিও না, তুমি যাও এদিকে, আমি ওই দিক টা দেখছি। মেলাতে লোকের সংখ্যা অনেক। চীৎকার শুনে একজন বলল,” কাঁকে খুঁজছেন? “ একটা ছোট্ট মেয়ে। বলল,” ছোট্ট একটা মেয়েকে দেখেছি পুতুল নাচের ওখানে বসে থাকতে।” দড়িয়ে গেলাম। দেখলাম মা আমাদের বসে পুতুল নাচ দেখছে। সে যে কি শান্তি তোমাকে বোঝাতে পারবো না। ওর বাবা ওকে জড়িয়ে ধরে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলো। তুমি যদি দেখতে সেই দৃশ্য। যত আবদার ছিল তার বাবার কাছে।

এখানের মেয়ে দেড় স্কুলে ভর্তি করে দিয়ে ছিল। স্কুল শেষে আমার এখানে এসে বসে থাকতো। বাবা কাজ শেষে যাওয়ার পথে নিয়ে যেতো। সে তো আজকের কথা নয়।

একদিন কি হোল জানেন?   বলেন। ও তখন দশম শ্রেণীর ছাত্রী। স্কুল শেষে আমার এখানে এসে বসে আছে। বাবা আসবে। কিন্তু সে আসছেনা। শম্ভু, এপাড়ার ছেলে, দোড়িয়ে এসে বলল,” হরি কাকা, করীম কাকা কে সাপে কামড়িয়েছে।” দোড়িয়ে গেলাম ওর চালের আরোতে। পড়ে আছে সে মেঝেতে। গুদামের ভিতর চালের বস্তায় হাত ঢুকিয়ে ছিল। কে জানতো সেখানে বসে আছে বিষধর গোখরো। এক ছোবল। ওঝা আসতে আসতে সব শেষ। বনানী তাকিয়ে থাকলো ওর বাবার মৃত দেহের দিকে। চোখে জল নেই। পাষাণ হয়ে গেছে। বললাম,’ কাঁদ মা মনি, কাঁদ”। সেই যে পাষাণ হয়ে গেলো আর কোনদিন ওর মুখে আমি হাসি দেখেনি।

জিজ্ঞাসা করলাম, ওর পড়াশুনা? ওই খানেই ইতি। মা আর এতদূরের স্কুলে পাঠাতে চাইনি। বিয়েয়ে দিয়ে ছিল এখানকার এক মাস্টারের সাথে। ছেলেটা বকা ঝকা করতো ওকে। মাঝে মাঝে আমার এখান থেকে তেল নুন নিতে আসত। হাসি দেখিনি ওর মুখে। পরান টা আমার ফেটে যেতো। একটা ছেলে হয়ে ছিল। বিধির কি খেলা কেউ জানেনে। ছেলের বয়স তখন চার অথবা পাঁচ। এক দুপুরে বনানী ঘুমিয়ে। ছেলে যে কখন দরজা খুলে বেড়িয়ে গেছে সে জানেনা। এই রাস্তাটা সে পাড় হতে চেয়ে ছিল। কিন্তু পারেনি। দোত্তের মত একটা ট্রাক এসে ধাক্কা দিয়ে ছিল। ছিটকে পড়ল ওই গাছটার নীচে। ছোট্ট ছেলেটার দেহ দুমড়ে কুঁচকে আরও ছোটো হয়ে গিয়েছিল। বনানী কিছুই জানেনা। দৌড়ে যেয়ে আমি ওকে নিয়ে এলাম। সেই মাংস পিণ্ডো টাকে বুকে চেপে হাউহাউ করে কাঁদতে থাকল। সান্ত্বনা দেওয়ার কোন ভাষা সেদিন ছিলোনা। অদৃষ্টের পরিহাস আরও কিছু বাকী ছিল। কয়েক মাস পর ওর স্বামী ওকে তালাক দিয়ে এই খান থেকে চলে গেলো। ওর মা চলে গেছে অনেক আগেই। শুধু আমিই ছিলাম। বললাম, “ এই ঘরটাতে এসে থাক”। এলো। নিজে নিজেই হাসত। আর ওই গাছটার নিচে যেয়ে বসে থাকতো। ছোটো ছোটো ছেলে দেখলে ধরতে যেতো। এই বলে হরিবাবু থামলেন।

বললাম, আজ বুঝতে পারছি কেন সে বলত ঝোলাতে গোখরো সাপ আছে, কেন সে ওই গাছটার নীচে বসে থাকতো। আমার দেখা ওর শেষ চাউনীতে এত মমতা কেন ছিল। হয়ত আমার মধ্যে খুঁজতে চেয়ে ছিল ওর হারানো ছেলে কে।

বলতে পারেন ওর কবর কত দুরে।

এই তো কাছেই। যাবেন।

চলেন। সেদিন সে আমাকে ছুতে পারেনি, আজ আমিই না হয় আমার হাত দিয়ে ওর কবর টা ছুঁয়ে আসবো.

You may also like

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *